ঝিকরগাছা উপজেলায় জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’এর পাঁচ জয়িতার গল্প

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:০৬ | অনলাইন সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম জীবন(মাল্টিমিডিয়া প্রতিনিধি) যশোরঃ

ঝিকরগাছার পাঁচ জয়িতার গল্প

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার স্থানীয় প্রশাসনের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ভুপালী সরকার, উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার অনিতা মল্লিক ও স্থানীয় পর্যায়ের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ক্রমে জয়িতা বাছাই কাজটি পরিচালিত হয়ে, সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী খুজে বের করে তারই নাম দেওয়া হয়েছে জয়িতা। এটি নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ গ্রহণ ও উদ্যোগটির নাম প্রকৃত দেওয়া হয় ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা পর্যায়ে একাধিক তথ্য থেকে চুল ছেড়া বিচার বিশ্লেষণ করে পাঁচজন জয়িতাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য আবদান রেখেছেন যে নারী, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী, সফল জননী নারী ও নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী এই পাঁচটি ক্যাটাগরিতে জীবন বৃত্তান্ত সহ নামের তালিকা চাওয়া হলে সর্বমোট ৭টি আবেদন জমা পরে। প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত গুলো পর্যালোচনা করে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ এর পাঁচ ক্যাটাগরিতে জয়িতা নির্বাচন করেছেন উপজেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ।


উপজেলায় জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’র পাঁচ জয়িতার জীবন গল্পের সারাংশের মধ্যে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য আবদান রেখেছেন যে নারীর ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন পৌর সদরের কৃষ্ণনগর গ্রামের মাহফুজুর রহমানের মেয়ে কথাসাহিত্যিক মাসুমা মিম (৫০)। তিনি বলেন, বাবা হারানোর কষ্টটা বুকে চেপে যখন নতুন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবছি তখনই মা চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। মাথার উপরের ছাদ আর পায়ের তলার মাটি দুটোই সরে গেল। আমি তখন ভাসমান। বাবা-মা হীন বাড়ি থেকে আট মাস পর বিয়ে হয়ে গেল। দাম্পত্য জীবন শুরু হলো বড়সড় এক যৌথ পরিবারে। এমন ব্যস্ত পরিবারে বাস করে লেখালেখি, চাকরী কোনোটাই করা সম্ভব না, ভেবে ক্ষুদ্র স্বপ্নটুকুও মাটি চাপা দিলাম। ঠিক তখনই ভালো বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ালো আমার স্বামী। তার অনুপ্রেরণায় লেখা শুরু করলাম। একুশে বইমেলায় প্রতি বছর বই বেরোতে লাগল। সংসার আর বাচ্চা সামলে চাকরী করা তখন অমূলক চিন্তা। স্বামীর অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতায় হয়ে গেলাম একজন শিক্ষা উদ্যোক্তা। ২০০২ সালে গড়ে তুললাম উন্নতমানের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। চোখের সামনে বেগম রোকেয়ার ছবিটি এঁকে পথ চলতে শুরু করলাম। আলহামদুল্লিাহ, স্কুলটি ২২ বছর যাবত সফলতার সাথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই সফলতার পেছনে রয়েছে একরাশ প্রতিকূলতার গল্প রয়েছে। সবার দায়িত্ব পালন করেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। স্কুল প্রতিষ্ঠায় শুধু পারিবারিক নয় এসেছে নানারকম পারিপার্শ্বিক বাঁধা। সব বাঁধাকে উপেক্ষা করে ‘সামাদ মেমোরিয়াল চাইল্ড লার্নিং হোম্স' একটি সফল স্কুল আর আমি একজন সফল ফাউন্ডার প্রিন্সিপাল। এখন আমি চাকরী খুঁজিনা, চাকরী দিই। স্কুলকে সাথে নিয়েই করে যাচ্ছি সামাজিক কাজ। শিশুদের হাত দিয়ে শীতবস্ত্র বিতরণ করি যাতে ওরা সামাজিক কাজের আনন্দ বোঝে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকে প্রতিবছর দেয়া হয় শিক্ষা উপকরণ, স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, জুতা ইত্যাদি। শিশুদের জন্য লিখেছি শিক্ষামূলক গল্প ও ছড়া। স্কুল থেকে প্রকাশিত হয় ‘জাগ্রত প্রতিভা' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা। যেখানে শিশুরা, শিক্ষকরা, বাবা-মায়েরা তাদের লেখা প্রকাশ করেন। শিশুদের মায়েদেরকে নিয়ে গড়ে তুলেছি ‘নিশানা লেডিস ক্লাব' যার সদস্য সংখ্যা দুই হাজার দুইশো। এই সমস্ত নারীদের সাথে নিয়ে সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করছি। বাল্যবিবাহ রোধ, যৌতুক ও নারী নির্যাতন বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখছি অনেক বছর যাবত। একজন সফল বক্তা হিসেবে অনলাইন, অফলাইনে রয়েছে জনপ্রিয়তা। নিজেকে সফল নারী ভাবতে আজ খুব বেশি ভালো লাগে । সবচেয়ে ভালো লাগে যখন দেখি এত বছরের সাধনা আর ধৈর্য্যের ফলাফল স্বরূপ পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক সমস্যা সমাধানে আমিই হয়ে উঠেছি সবার মধ্যমণি।


শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারীর ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন গদখালী ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের মাহমুদ হোসেনের সহধর্মিনী জুলিয়া সুকায়না (৪১)। তিনি বলেন, পরিবারের প্রথম সন্তান হওয়ায় পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার উদ্দেশ্যে এবং বিসিএসের প্রতি অদম্য স্পৃহা থাকার কারণে অনার্স পড়াকালীন তিনি বিসিএস-এর প্রস্তুতি শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় এর কারণে তিনি প্রথম বারই বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার লাভ করেন। ২৮তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে সহকারী কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পিরোজপুর ২০১০ সালে কর্মজীবন শুরু হয়ে খুলনার দিঘলিয়া ও সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি), কুষ্টিয়া সদর ও খুলনার পাইকগাছায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মাগুরায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), (রাজস্ব) ও (শিক্ষা ও আইসিটি) এবং বর্তমানে নড়াইলে স্থানীয় সরকারের উপ পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীর ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন পৌর সদরের পারবাজার গ্রামের আবুল হোসেনের মেয়ে তাসফিয়া আফরোজ (২৫)। তিনি বলেন, করোনাকালীন সময়ে আম্মুর কাছে ছিল মাত্র ১৫৫ টাকা। এছাড়া আর কোন পুঁজি ছিল না আমার। সেই ১৫৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা নিয়ে ফুলে রাজধানী গদখালীতে চলে গেলাম গোলাপ কিনতে। ১০০ টাকায় ১০০ পিস গোলাপ কিনলাম এবং বাড়িতে এসে পাশের বাড়ি থেকে নিম পাতা, সজনেপাতা এবং কাঁচাহলুদ চেয়ে আনি অল্প পরিমাণে। তারপর গোলাপের পাপড়ি নিমপাতা, সজনেপাতা ও কাঁচাহলুদ রোদে শুকিয়ে শিলে বেটে গুড়ো করি। তারপর সেই গুড়ো গুলোর ছবি ফেসবুকের একটি উদ্যোক্তা গ্রুপে পোস্ট করি। ২০২০ সালের শেষে থেকে ২০২১ সালের প্রথম অবদি আমার বিক্রয় হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা উপার্জন করি। আর বর্তমানে আমি এখন প্রতি সপ্তাহে দশ হাজার পিস গোলাপ কিনে এবং মাসিক চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ হাজার টাকা উপার্জন করি। আমার কম্পানীতে আমার মা-বাবা, নানি এবং আরো ৬ জন মহিলা কর্মী আছে। আমি উদ্যোক্তার পাশাপাশি বানিজ্য মন্ত্রালয় ও পিকেএসএফ এর প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছি। বিভিন্ন জেলায় আমার কাজগুলো প্রায় এক হাজার পাঁচশত নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এই সেক্টরে উদ্যোক্তা বাড়াতে আমি সক্ষম হয়েছি।


সফল জননী নারীর ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন নির্বাসখোলা ইউনিয়নের বল্লা গ্রামের জান আলী সরদারের মেয়ে মনজুয়ারা খাতুন (৫২)। তিনি বলেন, আমি লেখাপড়া শিখতে পারেনি। আমার স্বপ্ন ছিল সন্তানদেরকে আলোর পথ দেখাবো। সে জন্য আমি আমার ইচ্ছায় সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। সন্তানদেরকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলেছি। আমি স্বপ্ন দেখতাম আমার সন্তানেরা একদিন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে লেখাপড়া করবে। সৃষ্টিকর্তা ঠিকই আমার সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আমার দুই সন্তানই প্রাশ্চের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে। আমার বড় ছেলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সিনিয়ার কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ও পুত্রবধূ স্নাতকোত্তর এবং ছোট ছেলে বাংলাদেশ ক্রীড়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও পুত্রবধূ পিরোজপুর সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার।


নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারীর ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন, গদখালী ইউনিয়নের গদখালী গ্রামের সিরাজুল ইসলামের মেয়ে তাহুরা খাতুন (৩১)। তিনি বলেন, একজন মেয়ের বাবার বাড়িতে তার মা, আর স্বামীর বাড়িতে আর স্বামী না আসলে পৃথিবীতে তার আর কিছুই থাকে না। আমিও এই জীবনে না আসলে বুঝতে পরতম না যে, এই দুইজন মানুষের গুরুত্বটা কতখানী। অনেক মানুষের আহেলা, অনাদর পেয়েছি। মানুষের কুদৃষ্টি, কুপ্রস্তাব উপেক্ষা করে নিজেকে সংযত রেখেছি। আমি খুব স্বপ্ন দেখতাম সে বাবার বাড়ীতে এত দুঃখ কষ্ট হয়ত স্বামীর বাড়ীতে গেলে সব দুঃখ মুছে যাবে। কিন্তু আমি এতটাই কপাল পোড়া যে, আমার বিয়ে আড়াই বছর পর আমার স্বামী সড়ক দূরঘটনায় মৃত্যবরণ করেন।  স্বামী মৃত্যুর পরের দিন গুলোতে স্বামীর বাড়ির লোকজন শ্বশুর-শাশুড়ী ও ননদের নির্যাতন দিনে দিনে বাড়তে থাকলো। এমন একটা সময় আসলো যে, সেখানে সম্মানের সাথে থাকা দুষ্কর।  তাই আমি আমার বাবার বাড়ি আসি। কিন্তু আমার বাবাবাড়িতে থাকা আমার সৎ মা আমাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো না। আমার উপর শারীরিক ও মানুষিক ভাবেই নির্যাতন করা হয়েছে। অনেক বার আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চেয়েছি, কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে পারিনি। কারণ আমি মারা গেলে তো,  আমার জীবনের চেয়ে বেশি কষ্ট হবে আমার মেয়েটার জীবনে। তাই সব কষ্টকে উপেক্ষা করে আজ আমি উপজেলার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের জেন্ডার প্রমোটর হিসেবে কর্মরত।

উপজেলার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহিলা বিষয়ক অফিসার অনিতা মল্লিক বলেন, জয়িতারা হল বাংলাদেশের বাতিঘর। জয়িতাদের দেখে অন্য নারীরা অনুপ্রাণিত হলে ঘরে ঘরে জয়িতা সৃষ্টি হবে। তা হলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভুপালী সরকার বলেন,মনের অদম্য ইচ্ছাকে সকল প্রতিকূলতা জয় করে  বাস্তব রুপ দিয়ে নিজের পরিচয় তৈরি করা নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা । জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবাই সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়ে নারীজাতির অগ্রগামী উন্নয়নের সৈনিক হিসেবে লড়াই করে ও অবদান রেখে চলেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ কর্মসূচির মাধ্যমে জয়িতা সংবর্ধনার উদ্যোগ নিয়েছেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রার অংশীদার নারীজাতির অবদানকে স্বীকৃতিদানে এ উদ্যোগ সমাজের আপামর নারীর সাফল্য, নারীর জীবন সংগ্রাম, নারীর উন্নয়ন গোটা জাতির সামনে তুলে ধরার অনন্য নিদর্শন।