রাজশাহীর বাঘায় ট্রেনের নিচে পড়ে পেঁয়াজচাষির ‘আত্মহত্যা’

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:০৯ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

ট্রেনের নিচে পড়ে রাজশাহীর বাঘায় এক পেঁয়াজচাষি ‘আত্মহত্যা’ করেছেন, এমন একটি ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘হৃদয়বিদারক গল্প’ ছড়িয়ে পড়ে। যাঁরা এটি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন, তাঁদের সবাই ‘মূল গল্পটা’ একই রেখেছেন, শুধু ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা যুক্ত করে দিয়েছেন।

ফেসবুকের পোস্টে লেখা ছিল, ওই বৃদ্ধের স্ত্রী আট মাস আগে মারা গেছেন। দুই মেয়ে তাঁদের বাড়িতে কিছুদিন রেখে বের করে দিয়েছেন। দুই ছেলেও বাবার জিনিসপত্র ফেলে দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাতে ফেসবুকে এ ঘটনা পড়তে পড়তে মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে, একটি পরিবারের সবাই কি প্রায় ৭০ বছর বয়সী একজন মানুষকে এভাবে ত্যাগ করতে পারেন?

ফেসবুকে ঘটনাটি পড়ে সবাই বৃদ্ধের সন্তানদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে কমেন্ট করছিলেন। আমার স্ত্রী দুলারী খাতুনও ঘটনাটি পড়তে পড়তে খুব ‘আহা, আহা’ করছিলেন। কিন্তু আমার এমন মনে হচ্ছিল না। মনে আসে, কেউ ফেসবুকে ভিউ বাড়ানোর জন্য কাজটা করেনি তো? সিদ্ধান্ত নিলাম, সকালে উঠে ওই বৃদ্ধের বাড়িতে যাব।

এরপর ঘটনাস্থলে গেলাম। একটি শোকাহত পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য স্থানীয় পরিচিত কাউকে পেলে সুবিধা হয়। এ জন্য স্থানীয় সাংবাদিক আমার ঘনিষ্ঠ গোলাম তোফাজ্জল কবিরকে ডেকে নিলাম। মৃত ওই বৃদ্ধের নাম মীর রুহুল আমিন। তাঁর ভাতিজা মোফাক্কর হোসেনের সঙ্গে গোলাম তোফাজ্জলের ঘনিষ্ঠতা আছে। তিনি একটি জানাজায় ছিলেন। একটু সময় নিলেন। দুপুর গড়িয়ে গেল। দুজন বাঘা উপজেলার মাঝপাড়ার বাউসায় তাঁদের বাড়িতে যাই।

বাড়িতে গিয়ে পঞ্চাশোর্ধ এক নারীকে পাই। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া মীর রুহুল আমিনের স্ত্রী। অথচ ফেসবুকে লেখা হয়েছে, তাঁর স্ত্রী আট মাস আগে মারা গেছেন।

এরপর তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ছেলে-মেয়ে কয়জন? মরিয়ম বেগম বললেন, তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ২০-২২ বছর আগে মেয়ের বিয়ে হয়েছে ঈশ্বরদীতে, সেখানেই থাকেন। আর তাঁর ছেলে ঢাকায় একটি চাকরি করেন। সেখানে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। বাড়িতে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজন থাকতেন।

এরপর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে দুই সন্তানের জিনিসপত্র ফেলে দেওয়া, দরজা বন্ধ করে বাবাকে বাইরে রাখা, চলে যেতে বলা—ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ঘটনাগুলোর সত্যতা নেই।

মরিয়ম বেগম বলেন, তাঁদের কোনো অশান্তি নেই। ঘটনার দিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন। সকালে খেয়ে গেছেন। বেলা তিনটার আগে-পরে তাঁর সঙ্গে দুবার ফোনে কথা হয়েছে।

মীর রনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় একটা ছোট চাকরি করি। সেখানে বাবা-মাকে একবার রাখার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা গ্রাম ছেড়ে থাকতে পারেন না। তাই বাবা-মা চলে এসেছেন। ফেসবুকে যা লেখা হয়েছে, ষোলো আনা মিথ্যা। আমার মা এখনো বেঁচে আছেন। আমরা খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি।’

পরিবারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, পেঁয়াজ চাষের জন্য মীর রুহুল আমিন কোনো ঋণ করেছিলেন কি না। তখন তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম বলেন, এনজিও থেকে ঋণ করেছেন। কিন্তু কিস্তি খেলাপি হয়নি। নিয়মিত কিস্তি দিয়েছেন। এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই।

আমি স্থানীয় তিনটি এনজিও অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, মীর রুহুল আমিন তিনটি এনজিও থেকে ঋণ করেছেন। প্রতি সপ্তাহে তাঁর প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা ঋণের কিস্তি। এই টাকা পরিশোধ করার মতো সক্ষমতা তাঁর নেই।

মহাজন ও আড়তদারদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে হয়তো তিনি ঋণের কিস্তিটা নিয়মিত রেখেছিলেন, এমনটা বললেন তাঁর ভাতিজা। তিনি জমি বর্গা নিয়ে ১ বিঘা ৫ কাঠা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। এখন পেঁয়াজ তুলে এই টাকা তো আর শোধ করতে পারবেন না, এই দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যা করতে পারেন, এমনটা ভাতিজার ধারণা।

রেলওয়ে ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে কল করলে তিনি বলেন, পরিবারের সঙ্গে পুলিশ কথা বলে জানতে পেরেছেন, এই ঋণের দুশ্চিন্তায় মীর রুহুল আমিন ১৫–২০ দিন ধরে কারও সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলেননি। শারীরিক একটু সমস্যাও ছিল। মূলত ঋণের কারণে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন।

আমার বার্তা/এল/এমই