সুন্দরবনে আবারও বেড়েছে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন

সুন্দরবনে আবারও বেড়েছে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য। উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে ও বনজীবীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। কেউ বনে যেতে চাইলে, আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয় দস্যু বাহিনীর সঙ্গে। নির্ধারিত ‘মাশুল’ বা অর্থ পরিশোধ করলেই মিলছে অনুমতি। না হলে জিম্মি, নির্যাতন বা ছিনতাইসহ নানান বিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে। সেখানে অপরাধীদের একরকম অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক জেলে ও বাওয়ালিকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করেছে একাধিক জলদস্যু বাহিনী। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয়েছে জেলে প্রতি ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। বিকাশের মাধ্যমে টাকা আদায়ের পরই ছাড়া পেয়েছেন অপহৃতরা। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন ও কক্সবাজার এলাকার দেড় শতাধিক জলদস্যু অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের পর নতুন করে আবার দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ছে। এবার এই জলদস্যুরা সরাসরি নিজের নামে বাহিনী না গড়ে নতুন কাউকে সামনে রেখে তাদের নামে বাহিনী পরিচালনা করছে।

সুন্দরবনে নতুন করে অন্তত ১০টি জলদস্যু বাহিনী গড়ে উঠেছে। তবে কোস্ট গার্ড সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সুন্দরবনে নতুন করে তারা শুধু আলিফ ও কলিম শরীফ বাহিনীর তথ্য পেয়েছে।

গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর আত্মসমর্পণ করা সুন্দরবন অঞ্চলের জলদস্যুদের প্রায় সবাই আবারও দস্যুতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বলে তথ্য মিলছে। এর মধ্যে চলতি বছরের গত দুই মাসে সুন্দরবনে অন্তত ১৫০ জন জেলেকে অপহরণ করে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করেছে তারা। সর্বশেষ ছয়জন নারীসহ ৩৩ জন জেলেকে অপহরণ করা হয়েছে।

অপহরণের শিকার জেলেরা জানান, বনাঞ্চলের গভীরে নির্জন জায়গায় তাদের আটকে রেখে দিনের পর দিন ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।

খুলনার দাকোপ উপজেলার জেলে ফারুক হোসেন জানান, সম্প্রতি মাছ ধরতে গিয়ে চারজনসহ তিনি জলদস্যুদের হাতে পড়েন। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের গভীর বনে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক নির্যাতনের পর বিকাশে টাকা পেয়ে তাদের ছেড়ে দেয় দস্যুরা।

শ্যামনগরের জেলে রবিউল শেখ বলেন, ছয়জনকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে যায় দস্যুরা। মুক্তিপণের টাকা সময়মতো না পাঠানোয় আমাদের একজনকে বেধড়ক মারধর করে। এতে আমরা সবাই আতঙ্কে পড়ে যাই। এখন আর সুন্দরবনে যেতে সাহস হয় না।

কয়রার জেলে আব্দুল জলিল জানান, ভাইকে নিয়ে গিয়েছিল দস্যুরা। মাছ, জাল, ট্রলার সব ছিনিয়ে নিয়েছে। ভাই ফিরে এলেও আর আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারেনি। ভয় এখনও তাড়া করে ফেরে।

জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সুন্দরবনে শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনীসহ অন্তত সাত থেকে আটটি নতুন জলদস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি বাহিনীতে রয়েছে আট থেকে ১০ সদস্য। এদের হাতে থাকে দেশীয় রাইফেল, দো-নালা বন্দুক এবং ধারালো অস্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে কোস্ট গার্ডের কয়েকটি অভিযানে ধরা পড়েছে একাধিক জলদস্যু; উদ্ধার হয়েছেন অপহৃত জেলে ও বাওয়ালি।
 
সর্বশেষ গত ছয় মাসে পরিচালিত অভিযানে ২৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬০টি দেশীয় অস্ত্র, গুলি ও হাতবোমা উদ্ধার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের (পশ্চিম জোন) জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান বলেন, সুন্দরবনে জলদস্যু বেড়েছে এটা সত্য, এজন্য আমরাও আমাদের কার্যক্রম জোরদার করেছি। সুন্দরবনের ভিতরে আমরা বেশ কিছু জলদস্যু আস্তানার সন্ধান পেয়েছি এবং সেগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছি। সম্প্রতি অভিযানে আমরা ৩৩ জেলেকে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। সুন্দরবনে কেউ দস্যুতা করতে চাইলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।

সুন্দরবন বন বিভাগের বন সংরক্ষক মো. ইমরান হোসেন বলেন, সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত করা বন বিভাগের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা কোস্ট গার্ড, নৌ-বাহিনী, র‌্যাবসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েছি। তাদের সহায়তায় আমাদের তদারকিও বাড়ানো হয়েছে। আমরা একটা আলাদা টিম করতে চাই এটা দমনে। আশা করছি খুব দ্রুতই সুন্দরবন আবারও নিরাপদ হয়ে উঠবে।


আমার বার্তা/জেএইচ