খুলনায় স্বাস্থ্য সহকারী পদ শূন্য থাকায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১১:৩৩ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী পদে নতুন নিয়োগ না হওয়ায় খুলনার গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় জনবলের অর্ধেকেরও কম সংখ্যক কর্মী দিয়ে চলছে টিকাদান কর্মসূচি, মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। এতে করে গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার ৯টি উপজেলায় স্বাস্থ্য সহকারীর ৩৯০টি পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৮২ জন। অর্থাৎ, ২০৮টি পদই শূন্য পড়ে আছে।
 
সবশেষ ২০১০ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এরপর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দুইবার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মৃত্যু ও অবসরের কারণে জনবল সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। আর জনবল সংকটের কারণে একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
 
খুলনার বটিয়াঘাটার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে কর্মরত মো. আব্দুল হাইকে সপ্তাহে দু’দিন ২৫ কিলোমিটার দূরে জলমা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডেও সেবা দিতে হয়। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে একজন করে স্বাস্থ্য সহকারী থাকার বিধান রয়েছে।
 
আব্দুল হাই বলেন, ‘দুই ওয়ার্ডে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। সেখানে আমি একা কীভাবে শতভাগ সেবা দেব? নিয়ম অনুযায়ী দুই ওয়ার্ডে অন্তত ৪ জন স্বাস্থ্য সহকারী থাকার কথা। অথচ আমি একাই চারজনের কাজ করছি। শুধু ইপিআই টিকা দেয়া নয়, আরও অনেক কাজ রয়েছে, যা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’
 
জলমার গৃহিণী হালিমা আক্তার বলেন, ‘আগে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি এসে টিকার তারিখ জানাতেন। এখন আর কেউ আসে না। অনেক সময় টিকা দেয়ার খবরই জানি না। গর্ভবতী মা বা কিশোরীদের স্বাস্থ্যের খোঁজও কেউ নেয় না।’
 
একই এলাকার তরুণী মাহফুজা বলেন, ‘টিকা কেন্দ্রে অনেক ভিড় থাকে। আবার কোনো নারী স্বাস্থ্যকর্মী নেই। নিজেদের সমস্যা খোলাখুলি বলতে পারি না।’
 
উপজেলাভিত্তিক সংকট আরও প্রকট। তেরখাদায় ৩৪টি পদের মধ্যে কর্মরত ১৪ জন, রূপসায় ৩৫টির মধ্যে ১৬ জন, ফুলতলায় ১৯টির মধ্যে ৭ জন, কয়রায় ৪৪টির মধ্যে ২৩ জন, ডুমুরিয়ায় ৮০টির মধ্যে ২৩ জন, দিঘলিয়ায় ২৯টির মধ্যে ৫ জন, দাকোপে ৪৪টির মধ্যে ৩৫ জন, বটিয়াঘাটায় ৪০টির মধ্যে ১৭ জন ও পাইকগাছায় ৬৫টির মধ্যে ৪২ জন কর্মরত আছেন।
 
বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য সহকারী সুরাইয়া পারভীন আনু বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে জনসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এজন্য একে ‘এ’ ও ‘বি’ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আমি ‘বি’ গ্রুপে। এখানে ৪০ হাজার মানুষের বিপরীতে মাত্র ২ জন কাজ করি। প্রতিদিন প্রায় দেড়শ বাচ্চাকে টিকা দিতে হয়। এত মানুষের বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা, একদিনে একটি লাইনও শেষ করা যায় না। তারপরও আমাদের অস্বাস্থ্যকর জায়গায় বসে টিকা দিতে হয়, যা শিশু, অভিভাবক ও আমাদের সবার জন্যই কষ্টকর।’
 
আরেক স্বাস্থ্য সহকারী নাসরিন আক্তার বলেন, ‘আমাদের নির্দিষ্ট কোনো পোশাক নেই। অনেক সময় মানুষ বুঝতে পারে না আমরা কারা। নিয়ম হলো প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একজন স্বাস্থ্য সহকারী থাকবেন। কিন্তু এখানে ৪০ হাজার মানুষের জন্য আমরা মাত্র ২ জন কাজ করছি।’
 
বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের খুলনার সাধারণ সম্পাদক মো. মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে একদিকে স্বাস্থ্য সহকারীরা অতিরিক্ত চাপে পড়ছেন, অন্যদিকে মানুষ তাদের প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। দ্রুত নিয়োগ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সবশেষ ২০১০ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ হয়েছিল। এরপর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দুইবার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে অজানা কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে আছে।’
 
স্বাস্থ্য সহকারীদের এই সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন খুলনা সিভিল সার্জন ডা. মোছা. মাহফুজা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অসমাপ্ত কাজগুলো চালু করার চেষ্টা করছি। জনবল সংকটে স্বাস্থ্য সহকারীরা কষ্ট পাচ্ছেন, তবুও তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি দ্রুত সমাধান হবে।’


 আমার বার্তা/এল/এমই