ভারতে হত্যার শিকার ৩ বাংলাদেশির লাশ হস্তান্তর করলো বিএসএফ

প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩৭ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

ভারতে হত্যার শিকার ৩ বাংলাদেশির লাশ হস্তান্তর করলো বিএসএফ

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে হত্যার শিকার তিন বাংলাদেশীর লাশ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে হস্তান্তর করেছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিহতদের লাশ গ্রহণ করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশগুলো ভারতের খোয়াই জেলার সাম্পাহার থানায় ছিল।

নিহতরা হলেন- হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আলীনগর গ্রামের মরহুম আশ্বব উল্লার ছেলে জুয়েল মিয়া (৩০), বাসুল্লা গ্রামের কনা মিয়ার ছেলে পণ্ডিত মিয়া (৪৯) ও কবিলাশপুর গ্রামের কুদ্দুছ মিয়ার ছেলে সজল মিয়া (২৫)। তিনজনই উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা।

বিজিবি জানায়, কয়েক দিন আগে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশের পর এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। হবিগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (৫৫ বিজিবি)-এর দায়িত্বাধীন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্তবর্তী বিদ্যাবিল এলাকা দিয়ে তিন বাংলাদেশী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই থানার কারেঙ্গিছড়া এলাকায় প্রবেশ করেন।

নিহতদের পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার নিহত ব্যক্তিরা ভারতে কাজের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন।

ধারণা করা হচ্ছে, ভারতে অনুপ্রবেশের পর স্থানীয়রা চোর সন্দেহে তাদের ওপর হামলা চালান। এতে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান।

বিজিবির বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, ঘটনাস্থলটি সীমান্তের শূন্য রেখা থেকে প্রায় চার–পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে, যা ভারতের ৭০ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের আওতাধীন এলাকা।

হবিগঞ্জ ৫৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: তানজিলুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে- নিহতরা সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন। স্থানীয়রা চোর সন্দেহে তাদের আটক করে মারধর করে, এতে তারা প্রাণ হারান। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর সাথে যোগাযোগ করছি। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিকেলে পৌনে ৬টার দিকে ভারত থেকে নিহতদের স্ত্রীর নিকট লাশ হস্তান্তর করা হয়।

এসময় চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, বানিয়াচং সার্কেল প্রবাস কুমার সিংহ, মাধবপুর সার্কেল এ কে এম সালিমুল হক, চুনারুঘাট থানার ওসি মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, খোয়াই থানার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিশোর দেব বর্মা, ওসি কৃষ্ণ ধন সরকারসহ বিজিবি বিএসএফ উপস্থিত লাশ পরিবারের নিকট হস্তানতর করেন।

এসময় সজল মিয়ার স্ত্রী মারুফা, নিহত জুয়েল মিয়ার স্ত্রী মাজেদা আক্তার, নিহত পণ্ডিত মিয়ার স্ত্রী রুজিনা আক্তার উপস্থিত ছিলেন। নিহতদের স্ত্রীর কান্নায় ভেঙে পড়েছে আলীনগর, বাসুল্লা ও কবিলাষপুর গ্রাম।

ভারতের ত্রিপুরায় স্থানীয়দের হাতে তিন বাংলাদেশী নিহত হওয়ার খবরে স্বজনদের আহাজারিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম- হৃদয়বিদারক দৃশ্য। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নিহতদের স্ত্রী ও সন্তানরা।

নিহত সজল মিয়ার স্ত্রী মারুফা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামী দিনমজুর মানুষ। বিড়ির পাতা সংগ্রহের জন্য গত মঙ্গলবার সকালেই বের হয়েছিল। ভেবেছিলাম দুপুরে ফিরে আসবে। কিন্তু এখন শুনি, ভারতের লোকজন তাকে মেরে ফেলেছে! আমরা গরিব মানুষ, কোনো দোষ করিনি। তিনটা বাচ্চা নিয়ে আমি এখন কীভাবে বাঁচবো?

নিহত জুয়েল মিয়ার স্ত্রী মাজেদা আক্তার বিলাপ করে বলেন, আমার স্বামী নিরীহ মানুষ ছিল। কেমনে চলবো এখন? ভারতের লোকজন মেরে ফেলেছে আমার স্বামীকে। একবিন্দু দোষ না করেও তাকে জীবন দিতে হলো। সংসারে এখন কার ভরসায় থাকবো?

নিহত পণ্ডিত মিয়ার স্ত্রী রুজিনা আক্তার চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমার স্বামী বিড়ির পাতা জোগাড় করে দিতেন, আমি সেগুলো বিড়ি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। এতে কোনো মতে সংসার চলতো।

তিনি আরো বলেন, গত মঙ্গলবার বিড়ির পাতা সংগ্রহের জন্য বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকে তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনজনের লাশের ছবি দেখে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। এখন স্বামী নাই, রোজগার নাই, তিনটা সন্তান নিয়ে আমি কী করবো? কে খাওয়াবে তাদের? তিনটি পরিবারেই এখন শোক আর অনিশ্চয়তার ছায়া। স্বজনরা লাশ পেয়ে সরকারের কাছে তাদের বিচার ও সহযোগী জানিয়েছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মিজান মিয়া বলেন, আমরা সবাই তাদের চিনতাম। তারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দিনমুজুর মানুষ- কেউ বিড়ির পাতা সংগ্রহ করতো, কেউ তা বিক্রি করতো। জীবিকার তাগিদে তারা সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় যেত, কিন্তু কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িত ছিল না। যদি সত্যিই তাদের কোনো অপরাধ থাকতো, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যেত, পুলিশে হস্তান্তর করে মামলা করা যেত। কিন্তু এভাবে নিরীহ তিনজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা মানবিক নয়, এটা নির্মমতা।

তারা তিনজনই গরিব ঘরের মানুষ। পেটে খাবার জোগাতে প্রতিদিন পরিশ্রম করতো। এখন তাদের ঘরে শুধু কান্না আর আহাজারি। ছোট ছোট বাচ্চারা বাবার মুখ দেখতে চায়- কিন্তু তারা আর ফিরবে না। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো গরিব মানুষ এভাবে প্রাণ না হারায়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং সার্কেল) প্রবাস কুমার সিংহ বলেন, ‘ভারতীয় পুলিশ ও বিএসএফের কাছ থেকে আমরা তিন বাংলাদেশীর লাশ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছি। বর্তমানে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এই মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে নিহতদের পরিবার চাইলে আইনগত সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে তিনজনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের স্বজনেরা যদি মামলা করতে চান, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

খোয়াই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃষ্ণ ধন সরকার বলেন, ‘ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশী তিনজনসহ মোট পাঁচজনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে তিন বাংলাদেশী এবং এক ভারতীয় নাগরিক নিহত হন, আরেকজন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহত ব্যক্তিকে আমরা নজরদারিতে রেখেছি। এ ঘটনায় খোয়াই থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে আমরা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

 

 

আমার বার্তা/এল/এমই