আন্দোলনরতদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৫, ১০:৩৩ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন

আন্দোলনে দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যাকাণ্ড ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডের প্রধান মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শেখ হাসিনা বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং অভ্যুত্থান সময়ের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

সোমবার ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। পরে ট্রাইব্যুনালে সংবাদ সম্মেলন করে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।

নিয়মানুযায়ী তদন্ত সংস্থার জমা দেওয়া সব তথ্যপ্রমাণ ও আলামত চিফ প্রসিকিউটর আইন অনুযায়ী বিশ্লেষণ করবেন। তিনি তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করবেন। এরপর বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।

তাজুল ইসলাম বলেন, তদন্ত শুরুর ৬ মাস ২৮ দিনের মধ্যে প্রধান মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার হিসাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এতে জুলাই অভ্যুত্থানে দেশব্যাপী যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যাকাণ্ড, গুলি করে আহত, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড হয়েছিল, এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে মূলত পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম জানান, মোটা দাগে এ মামলাকে তারা গণহত্যা বলছেন না, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে মিল রেখে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলছেন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৪ জুলাই প্রেস কনফারেন্সে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তিনি রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতিপুতি বলেছিলেন। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও সহযোগী বাহিনী অক্সিলারি ফোর্স হিসাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, হত্যা করে, আহত করে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার এরকম অনেক টেলিফোন কনভারসেশন জব্দ করেছে তদন্ত সংস্থা। তিনি (শেখ হাসিনা) রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীকে হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারী সিভিলিয়ান পপুলেশন, তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে হত্যার নির্দেশ, গুলি করে আহত করার নির্দেশ এবং সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।

তাজুল ইসলাম বলেন, বাকি তিনটি অভিযোগ নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। তবে সেসব অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য তিনি সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করতে চাননি।

তিনি বলেন, জুলাইয়ের আন্দোলন দমাতে প্রায় দেড় হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করা হয়েছে। নারীদের ওপর সহিংসতা, ‘টার্গেট’ করে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ ও জীবিত মানুষকে একত্রিত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আহতদের হাসপাতালে নিতে, চিকিৎসা দিতে, এমনকি পোস্টমর্টেমেও বাধা দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় তদন্ত প্রতিবেদনে এসেছে। আন্দোলনকারীদের ওপর দায় চাপানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোক দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। এসবের দায় চাপানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছিল, তার টেলিফোনিক নির্দেশ তদন্ত সংস্থার হস্তগত হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।

এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় তিনবার বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০ এপ্রিল এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় দুই মাস বাড়ানো হয়। ২৪ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য এর আগেই প্রতিবেদন জমা দিল তদন্ত সংস্থা। এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো মামলার প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে দাখিল হলো। এর আগে ২১ এপ্রিল জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। শিগ্গিরই এ মামলার ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবে প্রসিকিউশন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই মামলা ছাড়াও ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। অভিযোগ দাখিলের পর প্রসিকিউশনের আবেদনে ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

২২টি মামলায় ১৪১ জন আসামি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে চিফ প্রসিকিউটরসহ ১৭ জন প্রসিকিউটর রয়েছেন। আর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় তদন্তকারী কর্মকর্তার সংখ্যা বর্তমানে ২৪ জন। তদন্ত সংস্থার সব সদস্যই পুলিশবাহিনী থেকে প্রেষণে বা চুক্তিভিত্তিক নিযুক্ত হয়েছেন।

প্রসিকিউশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩৩০টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। যেখানে ৩৯টি তদন্ত কার্যক্রম (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার অনুসারে) চলমান। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে মিস কেস হয়েছে ২২টি। এসব মিস কেসে সর্বমোট অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৪১ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার রয়েছেন ৫৪ জন, ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক ৮৭ জন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেসামরিক ব্যক্তি ৭০ জন, পুলিশ ৬২ জন, আর সামরিক ব্যক্তি ৯ জন। ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।

তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, যে কোনো ভুক্তভোগী তদন্ত সংস্থা কিংবা চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। চিফ প্রসিকিউটরের কাছে দাখিলকৃত অভিযোগ পরবর্তী সময়ে তদন্ত সংস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। প্রাপ্ত অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করবে। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে আসামি গ্রেপ্তারের জন্য ওয়ারেন্ট চাইতে পারেন। গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অনুমতি চাইতে পারেন। এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালে একটি ‘মিস কেস’ চালু হয়। তদন্ত সম্পন্নের পর তদন্ত কর্মকর্তা চিফ প্রসিকিউটর বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর ফরমাল চার্জ প্রস্তুত করে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। ট্রাইব্যুনাল ফরমাল চার্জ গ্রহণের পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করবেন। যেসব আসামি গ্রেপ্তার আছেন, তাদের আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্টের মাধ্যমে মূল কার্যক্রম শুরু হবে।


আমার বার্তা/জেএইচ