ড্যাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রড-সিমেন্ট, ক্যাবলসহ লিংকেজ কোম্পানি

প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:৪১ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

বৈষম্যমূলক ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ফার সংক্রান্ত সমস্যায় কমেছে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামোগত প্রকল্পের গতি। এতে আবাসন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিতে মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট প্রায় ২০০ লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিতে উৎপাদন কমেছে। কোনো কোনো শিল্পে বিক্রি কমে নেমে এসেছে অর্ধেকে। লোকসান কমাতে শিল্প মালিকেরা কর্মী ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাড়বে বেকারত্বের হার (কর্মী ছাঁটাই), ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।

মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আবাসন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির স্থবিরতা উত্তরণের লক্ষ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান খাত সংশ্লিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, নির্মাণ উপকরণের সবচেয়ে বড় উপাদান রড। সেই রডের চাহিদা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। গেল বছরের শেষের দিকে রড শিল্পের কয়েকটা সংগঠন যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল তাদের চাহিদা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এরপর গেলো ৪-৫ মাসে রডের চাহিদা আরও কমেছে।

শেখ মাসাদুল বলেন, ড্যাপের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সংস্কার না হলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। একটি কারখানা বন্ধের পর চালু হতে পাঁচ বছর সময় লেগে যায়, এতে বেকারত্ব বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। দেশের ভালোর জন্য হলেও সংকট দূর করা আবশ্যক।

বাংলাদেশ ইলেকট্রিক ক্যাবল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আখতার হোসেন ঢালি বলেন, আমাদের তারের চাহিদার ৯৮ ভাগ সরবরাহ করে থাকেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। আমাদের ব্যবসা আবাসন খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত।

আজ আবাসন সেক্টরের মন্দার কারণে আমাদের উৎপাদন কমেছে। আমার নিজের কারখানার ২৫ ভাগ শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছি। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে আরও ছাঁটাই করতে হবে। কারণ আমার বিক্রি কমেছে বা বিক্রি নেই। সেখানে উৎপাদন করে কী করব আমরা?

সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক শংকর রায় বলেন, আবাসনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি শিল্পের মতো সিমেন্টের চাহিদা কমেছে। আমাদের প্রতিটি কাঁচামাল আমদানি নির্ভর, এর ওপরে বিক্রি খরা। আমরা এ সংকটের সমাধান চাই। ব্যবসা বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে।

ব্যবসায়ী রাজ্জাক বলেন, আমার ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ, প্রতিষ্ঠানের কর্মী ৩৫০ জন থেকে এখন ৭৫-এ নামাতে বাধ্য হয়েছি। আমার মতো অন্যদের অবস্থাও একই রকমের। আমরা সমাধানের পথ চাই, ড্যাপের সংশোধন চাই।

বাংলাদেশ এলিভেটর এসকেলেটরস অ্যান্ড লিফট ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে সভাপতি এমদাদ উর রহমান বলেন, আমাদের লিফটের ব্যবসা অর্ধেকে নেমেছে। অনেক ব্যবসায়ী লোকসান এড়াতে ব্যবসা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ আবার কর্মী ছাঁটাই করছেন। লিংকেজ ব্যবসা অনেক বড়। প্রায় ৫০ লাখ নাগরিকের কর্মসংস্থান এবং দুই কোটি লোকের খাদ্যের সংস্থান হয়েছে এই গৃহায়ন শিল্পকে ঘিরে। আমরা ছাঁটাইয়ে বিশ্বাসী না, আমরা চাই আবাসনের সমস্যা দ্রুত সময়ে সমাধান করা হোক। আমরা ব্যবসা করতে চাই।

এ সময় টিম্বার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ তানভির হোসেন বলেন, কয়েক বছর ধরে আবাসন খাতে মন্থর অবস্থার কারণে আমাদের কাঠের ব্যবসায় ধস নেমেছে। সারা দেশে এই খাতের ১০ লাখ ব্যবসায়ী আছেন যাদের দেড় লাখের মতো থাকেন ঢাকা শহরে। যাদের প্রায় ৩০ হাজার ব্যবসায়ী এখন পথে বসেছেন।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, মৌলিক চাহিদার অন্যতম গৃহায়ন সমস্যা সমাধানে সরকারের সঙ্গে বড় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে আবাসন শিল্পের সদস্যদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান রিহ্যাব। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করাই রিহ্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য।

রিহ্যাব সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণেই আজ শহরগুলোতে সুন্দর সুন্দর নান্দনিক ভবন তৈরি হচ্ছে। আবাসন শিল্পের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে রড, সিমেন্ট, ইট, টাইলস, কেবল, রং, লিফট, থাই, স্যানিটারিসহ দুই শতাধিকের বেশি লিংকেজ শিল্প অর্থনীতির চাকা গতিশীল রেখেছে। প্রায় দুই কোটি লোকের খাদ্যের সংস্থান হয়েছে এই গৃহায়ন শিল্পকে ঘিরে। জিডিপিতে প্রায় ১৫ শতাংশ অবদান রয়েছে এই খাতের। এ খাতের সমাধান না করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি, বাড়বে বেকারত্ব।

রিহ্যাব সভাপতি বলেন, বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ নিয়ে ভূমি মালিক, আবাসন ব্যবসায়ী এবং এই সংক্রান্ত লিংকেজ শিল্পগুলোর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে। জমির মালিকের পাশাপাশি ফ্ল্যাটক্রেতা সবার মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনতে অবশ্যই আবাসন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির স্থবিরতা থেকে অতিদ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে। সরকারের এ ব্যাপারে একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেবেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিংকেজ শিল্প উদ্যোক্তারা বলেন, আবাসন খাত ভালো থাকলে আমাদের সংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভালো থাকার কথা। কিন্তু তারাও ভালো নেই। কারণ লিংকেজ শিল্পগুলোর সবশেষ প্রোডাক্টের বেশিরভাগ ক্রেতাই ডেভেলপাররা।

বৈষম্যমূলক ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন যাবৎ আবাসন শিল্প মারাত্মক সমস্যায় রয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে লিংকেজ শিল্পগুলোর ওপর। ড্যাপে ফার সমস্যাকে কেন্দ্র করে আমাদের ভবনের উচ্চতা এবং আয়তন একেবারে কমে গেছে। ফলে ২০২২ সালে ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর জমির মালিকরা ডেভেলপ করার জন্য আমাদের কোনো ভূমি দিচ্ছেন না। যার কারণে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো নতুন কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এতে লিংকেজ শিল্পগুলোর পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

তারা বলেন, সিমেন্ট, রড, ইটসহ অন্যান্য উপকরণের চাহিদা কমেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় কিছু কিছু পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে অনেকগুলো লিংকেজ শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তিন শিফটের উৎপাদন দুই শিফটে নামিয়ে দিয়েছে। আবার কেউ সেটা এক শিফটে নামিয়ে এনেছে। উৎপাদন কমানোর কারণে স্বাভাবিকভাবেই কর্মসংস্থান এখানে সংকুচিত হয়েছে। অনেক লোকবল ছাঁটাই হয়েছে এবং অনেকে সেই পথে হাঁটছেন। এক কথায় বলতে গেলে বৈষম্যমূলক ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ফার সংক্রান্ত সমস্যা এবং সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামোগত প্রকল্পের গতি কমে যাওয়াতে আবাসন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিতে মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে।

 

আমার বার্তা/এল/এমই