পেট্রোবাংলাকে দুই হাজার কোটি টাকার ‘নিরাপদ ঋণ’ দান

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:২২ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

দেশে পাইপলাইনে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে আমদানি করা এলএনজিসহ দেশীয় উৎস থেকে কেনা গ্যাসের মূল্য পরিশোধে ত্রাহি অবস্থা রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোবাংলার। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ছাড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি সরবরাহকারীদের দেনা পরিশোধে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছ থেকে।

এ ঋণকে ‘নিরাপদ ঋণ’ হিসেবে উল্লেখ করে দশমিক ২ শতাংশ মুনাফা নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ঋণ দেওয়া-নেওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, পেট্রোবাংলা তিনটি জাতীয় ও দুটি আন্তর্জাতিক গ্যাস কোম্পানির (আইওসি) বাংলাদেশি উৎস থেকে গ্যাস কিনে ছয়টি বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করে। দেশি উৎস থেকে চাহিদা মেটাতে না পেরে ২০১৮ সাল থেকে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএলসিএল) আওতাধীন তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, নরসিংদী এবং মেঘনা গ্যাস ফিল্ড থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ দেয়।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় এ ঋন আট মাসের গ্রেস পিরিয়ডের পরে নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করলে অর্থদণ্ডের শর্ত দেওয়া হয়েছে। আইওসি ও এলএনজি সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধের জন্যেই এ ঋণের অর্থ ব্যবহার করতে হবে।- বিপিসির সচিব (সরকারের উপসচিব) শাহিনা সুলতানা

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) তাদের আওতাধীন সিলেট, কৈলাসটিলা-১, কৈলাসটিলা-২, রশিদপুর ও বিয়ানিবাজার গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস সরবরাহ দেয় এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) তাদের আওতাধীন সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সেমুতাং, সুন্দালপুর, শ্রীকাইল, বেগমগঞ্জ ও রূপগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস সরবরাহ করে।

তাছাড়া দুই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরন ও তাল্লোর আওতাধীন জালালাবাদ, মৌলভীবাজার, বিবিয়ানা এবং বাঙ্গুরা গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ নেয়।

গত ১৬-২৩ এপ্রিল পাঁচদিনের তথ্যমতে, দেশি উৎসের তিন দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ৭৩০-৭৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট, আন্তর্জাতিক দুই প্রতিষ্ঠান শেভরন ও তাল্লো থেকে ১১৪০-১১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে ৮৩০-৮৩৫ মিলিয়ন ঘনফুটসহ সবমিলিয়ে ২৭০০ থেকে ২৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয় পেট্রোবাংলা।

এসব গ্যাস ৬ বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি (টিজিটিডিসিএল), বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (বিজিডিসিএল), কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল), জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড (জেজিটিডিএসএল), পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) মাধ্যমে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, চা বাগান, সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন, শিল্প কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং গৃহস্থালি গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৩৮-৪১ শতাংশ, সার কারখানায় ৫ শতাংশ এবং গৃহস্থালিসহ অন্য গ্রাহকদের ৫৪-৫৭ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়।

গত ২১ এপ্রিল পেট্রোবাংলার ৬০৭তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত ৮ মার্চ পর্যন্ত দেশীয় উৎস থেকে আন্তর্জাতিক গ্যাস সরবরাহকারী (আইওসি), এলএনজি সরবরাহকারী এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএলসি) ঋণ হিসেবে পেট্রোবাংলার কাছে পাওনার পরিমাণ আট হাজার ৮৭৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং পেট্রোবাংলার কাছে এনবিআরের ভ্যাট, এআইটি ও করের নিরঙ্কুশ দাবি ছিল ১৬ হাজার ৫৪৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

দুদিন আগে বিপিসির সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে। আমরা চেকও পেয়ে গেছি। কালকের মধ্যে নগদায়ন হতে পারে।- পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) একেএম মিজানুর রহমান

এতে পেট্রোবাংলার পরিশোধযোগ্য অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৪১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যার বিপরীতে পেট্রোবাংলার হিসাবে ওই সময়ে স্থিতির পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৯৬৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঋণ ও এনবিআরের পাওনা মিলে পরিশোধে ১৮ হাজার ৪৪৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ঘাটতি ছিল। অন্যদিকে, আইওসি ও এলএনজি সরবরাহকারীদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রদেয় অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় বিলম্ব সুদ বাবদ বিপুল অংকের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিধায় পেট্রোবাংলা তারল্য সংকটে পড়েছে বলেও সভায় আলোচনা হয়।

সভায় পর্ষদকে জানানো হয়, পেট্রোবাংলার অর্থ ঘাটতির কারণে আইওসি, এলএনজি (দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে ও স্পট মার্কেট থেকে) সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোবাংলার তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছিল। যে কারণে পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হলেও তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখার স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই।

এতে বলা হয়, পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিক্রি বাবদ একই সময়ে পিডিবি, আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট) এবং বিসিআইসির (সার কারখানার গ্যাস সরবরাহের জন্য) কাছে ২০ হাজার ৩৬২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বকেয়া ছিল। কিন্তু পেট্রোবাংলার কাছে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় এবং বিতরণ কোম্পানিগুলোর বকেয়া পাওনা অর্থ না পাওয়ায় দেশের চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি (গ্যাস) আমদানি ও সরবরাহ করতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছিল।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বিপিসির পর্যাপ্ত তারল্য থাকায় আইওসি ও এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা অর্থ পরিশোধ এবং আস্থা বজায় রাখতে বিপিসি থেকে দুই হাজার কোটি টাকা এক বছরের জন্য ঋণ দিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে অনুরোধ করে পেট্রোবাংলা। প্রাথমিক পর্যায়ে পেট্রোবাংলা এ ঋণ বিনা সুদে পাওয়ার অনুরোধ করে।

এ নিয়ে অর্থ বিভাগের মতামত চেয়ে গত ৬ এপ্রিল চিঠি দেয় পেট্রোবাংলা। পরবর্তীসময়ে ৯ এপ্রিল শর্তসাপেক্ষে অনাপত্তি দেয়। এই ঋণ বিপিসির আইন অনুযায়ী লাভজনক হিসেবে বিনিয়োগ ও বিপিসির পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। সুদের হার, ঋণ পরিশোধ সূচি, যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে অর্থদণ্ড নির্ধারণ করা, ওই ঋণ দেওয়া ও পরিশোধের কোনো পর্যায়েই অর্থ বিভাগের কোনোরূপ দায়-দায়িত্ব থাকবে না। এই ঋণ কোনোক্রমেই আইওসি এবং এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পাওনা অর্থ পরিশোধ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে না বলে অনাপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, অর্থবিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নির্দেশনার আলোকে ১৬ এপ্রিল বিপিসির ১০০৪তম পরিচালকমণ্ডলীর সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল এক পত্রের মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে অবগত করেন। এরপর ২০ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় শূন্য দশমিক ২ শতাংশ (০.২%) মুনাফার শর্তে বিপিসি পেট্রোবাংলাকে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রথম আট মাস গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে। পরবর্তী চার মাসে পেট্রোবাংলা ঋণ ও ঋণ পরিশোধ করার পরবর্তী তিন মাসে মুনাফা পরিশোধ করবে পেট্রোবাংলা। বিপিসি এবং পেট্রোবাংলা উভয়েই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বলে এ ঋণকে ‘নিরাপদ ঋণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো পেমেন্ট গ্যারান্টি প্রয়োজন হবে না।

পেট্রোবাংলা জানায়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২১ এপ্রিলের সভায় পরিচালক অর্থকে পরামর্শ দেওয়া হয়। পরে বিপিসির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে অনুমোদন দেয় পেট্রোবাংলার পর্ষদ।

বিষয়ে বিপিসির সচিব (সরকারের উপসচিব) শাহিনা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী পেট্রোবাংলাকে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দশমিক দুই শতাংশ মুনাফায় এক বছরের জন্য এ ঋণের বিষয়ে ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় এ ঋন আট মাসের গ্রেস পিরিয়ডের পরে নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করলে অর্থদণ্ডের শর্ত দেওয়া হয়েছে। আইওসি ও এলএনজি সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধের জন্যেই এ ঋণের অর্থ ব্যবহার করতে হবে।’

 


আমার বার্তা/এল/এমই