যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ: কোন দেশ ও খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৯ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণার ফলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির তহবিল হুমকির মুখে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বিদেশি সহায়তা পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় হলে স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এবং অন্যান্য বৈশ্বিক কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ কোটি কোটি ডলার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রকল্পের কর্মচারীদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার ফলে তারা ধাপে ধাপে সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র বৈদেশিক সহায়তার সবচেয়ে বড় দাতা দেশ। ২০২৩ সালে তারা বিশ্বব্যাপী মোট ৭২ বিলিয়ন (৭ হাজার ২০০ কোটি) ডলার সহায়তা দিয়েছে। এই সহায়তা খাদ্য নিরাপত্তা, সামরিক খাত, স্বাস্থ্যসেবা, মানবিক সহায়তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছে ইউক্রেন, যেখানে ১৬৬২ কোটি ডলার বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে ১৬৪৮ কোটি ডলার ছিল অর্থনৈতিক সহায়তা এবং ১৪ কোটি ডলার সামরিক খাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সহায়তা পেয়েছে ইসরায়েল, যা ছিল ৩৩১ কোটি ডলার, যার প্রায় পুরোটাই সামরিক খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়া পেয়েছে ১৭৭ কোটি ডলার, যার পুরোটাই অর্থনৈতিক সহায়তা।

এছাড়া, জর্ডান পেয়েছে ১৭২ কোটি ডলার (১২৯ কোটি অর্থনৈতিক এবং ৪৩ কোটি সামরিক সহায়তা), মিশর পেয়েছে ১৪৫ কোটি ডলার (২২ কোটি অর্থনৈতিক এবং ১২২ কোটি সামরিক সহায়তা)।

বাংলাদেশ ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট ৫৫ কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে, যার মধ্যে ৫১ কোটি ছিল অর্থনৈতিক এবং ৪ কোটি সামরিক সহায়তা।

যুক্তরাষ্ট্রের এই সহায়তা বন্ধের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবিক সহায়তার ওপর বড় প্রভাব পড়বে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন: ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক উন্নয়নে ১৯০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে। এই সহায়তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং শিক্ষা খাতে ব্যয় হতো।

স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্যসেবায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছিল ১৬০০ কোটি ডলার। এই সহায়তার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা এবং মাতৃস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো পরিচালিত হতো।

মানবিক সহায়তা: দুর্যোগ ও সংকটময় পরিস্থিতিতে ১৫৬০ কোটি ডলার মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদান, ইয়েমেন ও সোমালিয়ায় খাদ্য সহায়তা, শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও অন্যান্য জরুরি সেবা দেওয়া হতো।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা মূলত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবিক সহায়তা খাতে ব্যয় করা হতো। দেশটির অন্যতম বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত হয়, যা কলেরা, ডায়রিয়া ও অন্যান্য সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসা সেবা দেয়। সহায়তা কমার ফলে প্রতিষ্ঠানটি সহস্রাধিক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সহায়তা কর্মসূচিতেও যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা ছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি খাদ্য সহায়তা আপাতত নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার একটি বড় অংশ সামরিক খাতে ব্যবহৃত হয়। ২০২৩ সালে তারা ৮২০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যার অর্ধেক পেয়েছে ইসরায়েল ও মিশর।

ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০২৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৩৮০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। গাজা যুদ্ধের কারণে ইসরায়েল ইতোমধ্যেই অতিরিক্ত ১৭৮৯ কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে।

মিশরও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সহায়তা প্রাপ্ত দেশগুলোর একটি। ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর থেকে মিশর প্রতিবছর ১২০ কোটি ডলার সহায়তা পেয়ে আসছে।

বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হলে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

পিইপিএফএআর কর্মসূচি: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জরুরি এইডস সহায়তা কর্মসূচি (PEPFAR) ২০০৩ সালে চালু হয় এবং এটি বিশ্বের ৫০টি দেশে ১২ হাজার কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ২.৫ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫০ লাখ শিশু।

স্বাস্থ্য গবেষণা ও দাতব্য সংস্থাগুলো: আফ্রিকা ও এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল: সুদান, ইয়েমেন ও সোমালিয়ার মতো দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলোতে খাদ্য সহায়তা বন্ধ হলে লাখ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা স্থগিতের ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য এবং মানবিক সহায়তা খাত বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে, কারণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশে আইসিডিডিআর,বি-তে কর্মরত হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন।

বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের ফলে এই সহায়তা পুনরায় চালু হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমে গেলে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিকল্প তহবিল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

আমার বার্তা/জেএইচ