রাসেলস ভাইপারে তোলপাড়

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৪, ১১:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ

  ডয়েচে ভেলে

বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে চলছে তোলপাড়। বিভিন্ন এলাকায় এই সাপ নিধনে রীতিমতো অভিযান শুরু হয়ে গেছে। এক আওয়ামী লীগ নেতা সাপ প্রতি পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন।

পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সামন্ত লাল সেন দেশের মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তিনি বলেছেন সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনোম মজুদ আছে।

মে মাসের ৭ তারিখে রাসেলস ভাইপারের দংশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাকিনুর রহমানের মৃত্যু হয়। তিনি ওই দিন সন্ধ্যার পর পদ্মা নদীর ধারে আড্ডা দেয়ার সময়ে রাসেলস ভাইপার তাকে দংশন করে। তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। তবে এর আগেও গত তিন মাসে পদ্মা এবং আড়িয়াল খাঁ নদী তীরবর্তী জনপদে রাজশাহী, ফরিদপুর ও ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে অন্তত পাঁচ জনের মৃত্যু হয় রাসেলস ভাইপারের দংশনে।

এছাড়াও রাজশাহীর চারঘাট, গোদাগাড়ী, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, চাঁদপুরের মতলবসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা পাওয়া গেছে রাসেলস ভাইপারের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মৃত্যুর পর রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

রাজশাহীর এক আওয়ামী লীগ নেতা প্রতিটি রাসেলস ভাইপারের জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমেও খবরের সঙ্গে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

এপর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১২টি রাসেলস ভাইপার পিটিয়ে হত্যার খবর সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে। সর্বশেষ চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় শুক্রবার রাসেল ভাইপার মনে করে পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি অজগরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

গাজীপুরের শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের সরীসৃপ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সোহেল রানা বলেন, রাসেলস ভাইপার অবশ্যই অতি বিষধর একটি সাপ। আগে থেকেই বাংলাদেশের ২৪ জেলায় এর উপস্থিতি ছিল। এখন হয়তো ২৭-২৮ জেলায় এর বিস্তৃতি হয়েছে। কিন্তু এই সাপ আক্রান্ত না হলে বা তাকে কেউ বিরক্ত না করলে সে ছোবল দেয় না।

তার কথা, এই সাপটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছাড়ানো হচ্ছে। ফলে এখন মানুষের রোষের মুখে পড়ছে সাপটি। আর এই সাপটিকে মারতে গিয়ে অন্য প্রজাতির সাপও মেরে ফেলা হচ্ছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশে মোটামুটি ১০৪ প্রজাতির সাপ আছে। তাদের মধ্যে ৩০ প্রজাতির সাপ বিষধর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সাপের দংশনে সাড়ে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর দংশনের ঘটনা ঘটেছে চার লাখ। এরমধ্যে রাসেলস ভাইপার কতটি দংশন করেছে তার হিসাব নেই।

সোহেল রানা বলেন, এই মৃত্যুর প্রধান কারণ অসচেতনতা। তার কথায়, হাসপাতালে না গিয়ে তারা ওঝার কাছে গিয়ে তিন-চার ঘণ্টা সময় নষ্ট করেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে অ্যান্টিভেনোম ইনজেকশন দিলে রোগী বেঁচে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মেখলেসুর রহমান বলেন, বলা হচ্ছে এই সাপটি আগে বাংলাদেশে ছিল না। আসলে এটা আমাদের এখানে অনেক বছর ধরেই আছে। ভারতেও এই সাপ আছে। বাংলাদেশে পদ্মা নদীর উত্তর পাড়ে অনেক আগে থেকেই এই সাপ আছে। সাধারণত এর ইঁদুর এবং ইঁদুর জাতীয় প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। নানা কারণে তাদের আবাস স্থল নষ্ট হওয়া এবং খাবারের সংকট হওয়ায় হয়তো তারা ছড়িয়ে পড়ছে। নদী ও বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে।

তার কথা, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হঠাৎ করেই এই সাপটি নিয়ে প্রচারণা হচ্ছে। ফলে সাপটি এখন মারা পড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছে। এই সাপ মনে করো অন্য প্রজাতির সাপ মারা হচ্ছে। গুজব ছড়ানো হচ্ছে যে এই সাপটি মানুষ দেখলে লাফিয়ে লাফিয়ে দংশন করে। এই তথ্য মোটেই ঠিক নয়। শুধু রাসেলস ভাইপার কেন কোনো সাপই নিজে আক্রান্ত না হলে দংশন করে না।

কৃষি ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক সৈয়দা বদরুন্নেসা বলেন, একটি আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এভাবে সাপ মারলে আমাদের কৃষি এবং পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ সাপ যদি ইঁদুর না খায় বা ইঁদুর খাওয়ার মতো সাপ না থাকে তাহলে ইঁদুর বেড়ে যাবে। তখন ফসলের ক্ষতি হবে।

তার কথায়, আমরা সাপের আবাসস্থল ধ্বংস করছি। জলাভূমি নষ্ট করছি। বন ধ্বংস করছি। তারা কোথায় যাবে? আমাদের যেমন সাপ সম্পর্কে সচেতন থেকে জীবন রক্ষা করতে হবে। তেমনি তাদের জীবনও রক্ষা করতে হবে।

এদিকে বিষধর রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। তিনি শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি বলব, আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। রাসেলস ভাইপারে দংশনের যে ওষুধ তা আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আমি পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছি কোনো অবস্থাতেই অ্যান্টিভেনোমের ঘাটতি থাকা যাবে না।

ডা. সামন্ত লাল বলেন, সর্পদংশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। অনতিবিলম্বে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে এক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, সাপে কাটলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওঝা বা নিজেরা চিকিৎসা করা যাবে না।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, যদি সাপে কাটার পর রোগীর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ঢোক গিলতে কষ্ট হয় তাহলে বুঝতে হবে সাপটি বিষধর।

আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, বিষধর সাপে দংশন করলে সাথে সাথেই মানুষ মারা যাবে এটা গুজব। আসলে এটা নির্ভর করে রক্ত প্রবাহের উপর। তবে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। অভিযোগ উঠেছে সাপে কাটার একমাত্র চিকিৎসা অ্যান্টিভেনোম ঠিক মতো কাজ করছে না। এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেখা উচিত আর পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করা দরকার। তবে কোনোভাবেই আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না।

বনবিভাগ সাপ না মেরে ছয় দফা পরামর্শ দিয়েছে-

১. সাপ দেখলে তা এড়িয়ে চলুন, সাপ দেখলে তা ধরা বা মারার চেষ্টা করবেন না। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য নিন বা নিকটতম বন বিভাগ অফিসে খবর দিন।

২. যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার দেখা গিয়েছে, সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন।

৩. রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট ব্যবহার করুন।

৪. সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। রোগীকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। দংশিত স্থানের উপরে হালকা করে বেঁধে দিন।

৫. রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যান।

৬. আতঙ্কিত হবেন না, রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টি-ভেনোম নিকটস্থ হাসপাতালেই পাওয়া যায়।


আমার বার্তা/জেএইচ