সেই গৃহকর্মীর স্বামীকে ব্যাংকের এসপিও পদে নিয়োগ দেয় এস আলম

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:৩৮ | অনলাইন সংস্করণ

  অনলাইন ডেস্ক

দেশে বহুদিন ধরে আলোচনার বা বিতর্কের শীর্ষে রয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ এবং এর কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। এদিকে সাইফুল আলমের গৃহকর্মী মর্জিনা আকতারের ব্যাংক হিসাবে অন্তত ১ কোটি টাকা জমা থাকার তথ্য পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

আবার নতুন করে জানা যাচ্ছে, সেই গৃহকর্মীর স্বামী সাদ্দাম হোসেনকে ইসলামী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ মুখ্য কর্মকর্তা (এসপিও) পদে সরাসরি নিয়োগ দিয়েছে তার মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ। গত মে মাসে এই নিয়োগ দেওয়ার সময় ব্যাংকের নিয়োগ সম্পর্কিত নিয়মের ব্যত্যয় করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণেরা কর্মকর্তা পদে যোগ দেন, এরপর তিন বছর পর তারা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান। এরপর মুখ্য কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ মুখ্য কর্মকর্তা (এসপিও) পদে পদোন্নতি মেলে। এসপিও হতে কারও কারও ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। অথচ নতুন কর্মী নেওয়ার ধারাবাহিকতায় গত ১৩ মে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি ইসলামী ব্যাংকে এসপিও হিসেবে নিয়োগ পান সাদ্দাম হোসেন। তার মূল বেতন ধরা হয় ৫৫ হাজার টাকা। তবে সব মিলিয়ে প্রতি মাসে এক লাখ টাকার বেশি বেতন-ভাতা পান তিনি।

আরও জানা গেছে, নিয়োগের পর সাদ্দাম হোসেনকে প্রথমে পদায়ন করা হয় ব্যাংকটির চট্টগ্রামের দক্ষিণ জোনে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাকে চট্টগ্রামের চকবাজার শাখায় পদায়ন করা হয়। ব্যাংকে তিনি পরিচিত এস আলমের লোক (এস আলম’স ম্যান) হিসেবে। পদায়নের পর তিনি নিয়মিত অফিস না করলেও এখন তিনি অফিসে যাচ্ছেন।

নিয়োগের পর সাদ্দাম হোসেনকে প্রথমে যেখানে পদায়ন করা হয়, সেই দক্ষিণ জোন ওই এলাকার শাখাগুলোর নিয়ন্ত্রক কার্যালয়। সেখানকার একজন কর্মকর্তা বলেন, এস আলম’স ম্যান হিসেবে পরিচিত সাদ্দাম হোসেনের কোনো কাজ ছিল না এবং তিনি নিয়মিত অফিসেও আসতেন না। সবাই তাকে ভয় পেত।

ইসলামী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাদ্দাম হোসেনকে যখন নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ছিলেন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন। তিনি সাইফুল আলমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। সাদ্দাম হোসেনের নিয়োগের সময় জীবনবৃত্তান্ত ছাড়া আর কোনো নথিপত্র ব্যাংকে জমা পড়েনি। এরপরও তাকে নিয়োগ দেন আকিজ উদ্দিন। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকে এসপিও পদে সরাসরি নিয়োগের কোনো নিয়ম নেই।

ব্যাংকে জমা দেওয়া নথিপত্র অনুযায়ী, সাদ্দাম হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার মুন্সিরহাটের দক্ষিণ বাগবেড়ে। তার বয়স ৩১ বছর ৮ মাস। ২০০৭ সালে এসএসসি ও ২০১০ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করেন তিনি। ২০১৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ২০১৯ সালে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আকিজ উদ্দিন ইসলামী ব্যাংক ছেড়ে গেছেন। এমনকি তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। তার ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। এ ছাড়া আকিজ উদ্দিনের সংশ্লিষ্টতা আছে এমন চার প্রতিষ্ঠানের হিসাবে থাকা ১০০ কোটি টাকা জব্দ করেছে সংস্থাটি।

নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যাংকে নিয়োগ ও সরকারি জমি দখলের অভিযোগের বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এনবিআরের কর অঞ্চল-১৫-এর একটি অনুসন্ধানী দল এস আলম পরিবারের কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্ত করছে। ওই তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে।

এদিকে এস আলমের ক্ষমতা ব্যবহার করে সাদ্দাম হোসেন ও তার স্ত্রী মর্জিনা আকতারের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার সরকারি পুকুর এবং জনসাধারণের যাতায়াতের রাস্তা দখলেরও অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে স্থানীয় প্রশাসন। এরই মধ্যে কিছু জমি উদ্ধার করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, ইতিমধ্যে কিছু সরকারি জমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। শেষ হলেই পুরো চিত্র বের হবে।

জানা গেছে, মর্জিনা আকতারের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বেশ কয়েকটি হিসাব খোলা হয়। শহরের প্রবর্তক মোড়ে অবস্থিত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখায় মর্জিনা আকতারের হিসাবে গত ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে নথিপত্রে দেখা গেছে। তবে ওই হিসাবে আর উত্তোলনযোগ্য অর্থ নেই বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।

সাইফুল আলমের চট্টগ্রামের বাসায় এক দশক ধরে কাজ করেছেন গৃহকর্মী মর্জিনা আকতার। এনবিআরের যে তদন্ত দল এস আলম পরিবারের সদস্যদের কর ফাঁকির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে, তারা ইসলামী ব্যাংকে মর্জিনা আকতারের নামে থাকা ২২টি হিসাবে এক কোটি টাকার বেশি স্থায়ী আমানতের সন্ধান পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেওয়া হয়, যেখানে চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলমের ছেলে আহসানুল হক।

আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার পর প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয় এস আলম গ্রুপ। তাদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলে চাকরিচ্যুত করার দাবি করেছেন ব্যাংকের পুরোনো কর্মীরা। এদিকে কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকেই নামে-বেনামে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই এস আলম গ্রুপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ।

ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক—দুটোই এস আলম গ্রুপের মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুল আলম নিজেই। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক দুটি এস আলমমুক্ত করা হয়।

সূত্র: প্রথম আলো

আমার বার্তা/জেএইচ