সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নে ঐকমত্যের পথ খুঁজছে সরকার

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:০৮ | অনলাইন সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক:

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো এখন তাদের কাজের শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত ছয়টি কমিশনকে সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য ৩১ ডিসেম্বরের সময় দেওয়া হয়েছিল। তবে নির্ধারিত সময়ে রিপোর্ট জমা না দেওয়ায়, সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি কমিশনকে ১৫ জানুয়ারি এবং একটি কমিশনকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। যদিও এসব কমিশন তাদের প্রস্তাবনা প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে, তবুও এখন শেষ মুহূর্তে কিছু সংশোধনী নিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছে কমিশনগুলো। প্রশ্ন উঠছে—এসব সুপারিশ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? 

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, রাষ্ট্রের নানা স্তরে সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে। সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন—এসব খাত নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি, এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সংস্কারের কাজ অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারে না। তাদের মতে, এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে হওয়া উচিৎ। এই অবস্থায়, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সরকারের জন্য কঠিন হতে পারে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, সরকার একটি নতুন পদক্ষেপ হিসেবে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠন করতে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যে ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সংস্কারের কাজ বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। এজন্য একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠন করা হবে, যা রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পক্ষের মতামত নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। এই কমিশনের কাজ হবে, যেসব বিষয়ে সব পক্ষ একমত হতে পারবে, সেগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ দেওয়া।

তবে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন গঠন করার পরেও, এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিশেষত, শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকেও সংস্কারের বিষয়ে পৃথক দাবি উঠেছে। ছাত্ররা সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি জানাচ্ছে এবং গণপরিষদ নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। তারা বলছে—১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্লিখন করে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সাজানো উচিৎ। রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক দাবি বিদ্যমান, যা সবগুলো একত্রিত করে সুপারিশ বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন সরকারের জন্য একটি কঠিন ও জটিল কাজ হতে পারে। কারণ, সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থায় ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সরকার যে সংস্কারগুলোর সুপারিশ চূড়ান্ত করবে, তা রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এছাড়া, জনপ্রশাসনের সংস্কারের প্রস্তাবের ব্যাপারে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আপত্তি রয়েছে। তারা মনে করছেন— প্রশাসন ক্যাডারের অতিরিক্ত ক্ষমতা ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। অন্যদিকে, অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশাসন আরও শক্তিশালী করা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারি মনে করেন, সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি। তিনি বলেন, এই সংস্কার যদি সঠিকভাবে না করা হয়, তবে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল হয়ে যাবে। তিনি সরকারের প্রতি পরামর্শ দেন, যেন একটি গ্রহণযোগ্য এবং বৈধ জাতীয় ঐকমত্য গঠনের মাধ্যমে সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়। তিনি বলেন, ছাত্রদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ তারা দেশের ভবিষ্যৎ এবং সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন।

এদিকে, সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সাথে অংশীজনদের আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে তিনি বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা দীর্ঘ সময় নেয় এবং অনেক সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে পারে।

জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির পক্ষ থেকে যে দাবি উঠেছে, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তারা মনে করছে, সংস্কারের জন্য অতিরিক্ত সময় নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র হতে পারে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, সংস্কারের জন্য অতিরিক্ত সময় গেলে সমস্যাগুলো আরও বাড়বে, তবে তারা নির্বাচন চান, কিন্তু সংস্কার সাপেক্ষে।


আমার বার্তা/এমই