রেলের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, রাত থেকেই ট্রেন চলাচল শুরু
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৬ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন
বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিক সুবিধার দাবিতে সারাদেশে চলমান কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সাইদুর রহমান।
শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সমস্যার সমাধান শেষে বৈঠক থেকে বের হয়ে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) দিবাগত রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহার হয়েছে বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে একটি ছবিও পোস্ট করেন তিনি। এতে দেখা যায় অন্যান্যের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও উপস্থিত রয়েছেন।
রাত সোয়া ২টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট হাসনাত আবদুল্লাহ লিখেছেন, রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধর্মঘট প্রত্যাহার। শ্রমিক নেতাদের সাথে নিয়ে আমরা রেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমস্যার সমাধান করতে রেল উপদেষ্টার সাথে দেখা করেছি। এ বিষয়ে প্রেস কনফারেন্স রাত ২টা ৩০ মিনিটে।
এদিকে, বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, কর্মবিরতির কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে আন্দোলনরত রেলের রানিং স্টাফ নেতাদের সঙ্গে আজ মধ্য রাতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ৪ নম্বর মিন্টু রোড বাসায় বৈঠক হয়েছে। সেখানে বিএনপির নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস উপস্থিত ছিলেন।
পরে রাত আড়াইটার দিকে ব্রিফিং করে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, আমাদের সমস্যা বুধবারের মধ্যে সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছেন উপদেষ্টা মহোদয়। আমরা জনদুর্ভোগ চাই না। দুঃখ প্রকাশ করছি। এখন থেকে ধর্মঘট বাদ দিচ্ছি। কর্মবিরতি প্রত্যাহার করলাম।
পরে রাত পৌনে ৩টার দিকে রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সাইদুর রহমান বলেন, উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন আজকের (বুধবার) মধ্যে আমাদের দাবি মেনে নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এমন আশ্বাসে আমরা আমাদের কর্মবিরতি বুধবার রাত ২টা ৪৭ মিনিটে প্রত্যাহার করে নিয়েছি। রাত থেকেই ট্রেন চলাচল শুরু হবে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, রাত ৩টার দিকে রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী আফজাল হোসেন বলেন, রেলওয়ে উপদেষ্টা স্যারের বাসায় আমার উভয় পক্ষ বসে বৈঠক করেছি। উপদেষ্টা স্যারের আশ্বাসে আন্দোলনকারী অর্থাৎ রানিং স্টাফ নেতারা তাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এবং বৈঠক শেষে ট্রেন চালানোর ঘোষণা দেন। ফলে বুধবার মধ্যরাত থেকেই ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। সকাল থেকে পুরোদমে ট্রেন চলবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে মাইলেজ সুবিধার দাবিতে সোমবার রাত ১২টার পর থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা (রানিং স্টাফের মধ্যে রয়েছেন ট্রেন চালক, গার্ড ও টিকিট চেকার পদধারীরা)। এরপর থেকেই সারাদেশের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় রেল চলাচল। বাতিল করা হয় আন্তঃনগর-লোকালসহ সকল ট্রেনের যাত্রা। দিনভর ভোগান্তিতে ছিলেন সাধারণ যাত্রীরা।
এ পরিস্থিতিতে সকালে কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শন করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি জানান, আলোচনার দরজা খোলা আছে। প্রয়োজনে আবারও আলোচনা করা হবে।
এরপর দুপুরে সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, রেলকর্মীদের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। অন্য দাবিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখবে। যে কোনো যৌক্তিক দাবি এলে অর্থ মন্ত্রণালয় মানা করবে না।
বিষয়টির সমাধানে আন্দোলনরত রানিং স্টাফদের নিয়ে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি রুমে বৈঠকে বসেন রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম। সেখানে আন্দোলনরত রানিং স্টাফদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তবে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি রুমে দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকেও কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি।
প্রসঙ্গত, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় (হেডকোয়ার্টার) হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে (আউটার স্টেশন) হলে ৮ ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনো রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময়ে কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়। যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়।
এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা। এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে চাইলে সর্বশেষ গত ২৩ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় রেলপথ মন্ত্রণালয়কে জানায়, ‘২০২২ সালের ২১ আগস্ট অর্থ বিভাগের ৯১নং স্মারকে জারি করা পত্রের (খ) অনুচ্ছেদটি অপরিবর্তিত রাখা হলো এবং (ক) অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপে সংশোধন করা হলো।
সংশোধনে বলা হয়, রানিং স্টাফ হিসেবে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভ্রমণ ভাতা বা দৈনিক ভাতার পরিবর্তে রেলওয়ে এস্টাবিলিশমেন্ট কোডের বিধান অনুযায়ী রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্য হবেন। চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা প্রাপ্য হবেন না এবং মাসিক রানিং অ্যালাউন্সের পরিমাণ প্রাপ্য মূল বেতনের চেয়ে বেশি হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই মত জানার পর আরও ফুঁসে ওঠেন রানিং স্টাফরা। তারা বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৮ ঘণ্টার বেশি আমরা কাজ করব। আমরা তো সবাই টাকার জন্যই কাজ করি। ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে যদি টাকাই না দেয়, তাহলে আমরা কাজ করব কেন?
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি জানিয়েছে, কর্মচারীদের অবসরোত্তর ৭৫ শতাংশ মাইলেজ মূল বেতনের সঙ্গে যোগ করে পেনশন নির্ধারণের বিধান প্রায় ১৬০ বছর ধরে চলমান ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে রেলওয়ের কোডিফাইড রুল অমান্য করে রানিং স্টাফদের পার্ট অব পে হিসেবে গণ্য মাইলেজ, যা যুগ যুগ ধরে বেতন খাতের অংশ ছিল, সেখান থেকে সরিয়ে টিএ খাতে নেওয়ার ফলে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মাইলেজ যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানায়।
কর্মচারী সমিতি আরও জানিয়েছে, ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১০ এপ্রিল রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয় ১৩ এপ্রিল চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে তৎকালীন রেলমন্ত্রী ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে এ সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন। যার ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১১ জুন তৎকালীন রেলওয়ের মহাপরিচালক স্পষ্ট করে রানিং স্টাফদের মাইলেজ যোগে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই বছর ১৮ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আবারও আপত্তি জানায়। ফলে রানিং স্টাফদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছিল।
আমার বার্তা/জেএইচ