ভূমিকম্পের রেড জোনে সিলেট, মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেই
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেট তথা `ডাউকি ফল্ট’র ওপর দাঁড়িয়ে সিলেট। শহর থেকে প্রায় ৫৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার দূরে ভূগর্ভস্থ এই ফল্ট। ভৌগোলিকভাবে সিলেটের দক্ষিণ প্রান্তে ডাউকি ফল্ট এবং উত্তর-পূর্বে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কপিলি ফল্ট দুটিই সিলেটের কাছাকাছি। যেকোনো একটিতে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে সিলেট। এই টেকটোনিক প্লেট বা ভূগর্ভস্থ একাধিক চ্যুতি সক্রিয় থাকায় সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ চিহ্নিত করে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বড় ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন দফায় দফায় মৃদু কম্পন হতে পারে। ২০২১ সালের ২৯ মে একদিনে চারবার এবং ২৪ ঘণ্টায় ৭ বার ভূমিকম্প হয়েছিল সিলেটে। আর সিলেট থেকে খুব বেশি দূরে নয় রাজধানী ঢাকা। ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে প্রভাব পড়বে রাজধানীসহ দেশের অনেক অঞ্চলেই।
নরসিংদীর মাধবদীতে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ব্যাপক ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনায় এবার আলোচনায় এসেছে ডাউকি ফল্ট। বিশেষজ্ঞরা বার বার সতর্ক বার্তা দিয়ে এলেও যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি শূন্যের কোঠায়।
সিলেট ডেঞ্জার জোনে থাকলেও সে তুলনায় নেই প্রস্তুতি। ফলে যেকোনো সময় উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে অবর্ণনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হলে কিছুই করার থাকবে না। এরই মধ্যে সর্বশেষ শুক্রবার ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় প্রাণহানি ও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেদিন অন্য জেলার মতো কেঁপে উঠে সিলেটও। ঢাকা বিভাগের নরসিংদী জেলার মাধবদীতে উৎপত্তি হওয়ায় সিলেট অঞ্চলে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এটি যদি আসাম, ত্রিপুরায় হতো তাহলে ভয়াবহ ক্ষতি হতো সিলেটে।
ভূতাত্বিক জরিপ অনুযায়ী, এ অঞ্চলে ১৮৯৭ এবং ১৯৮০ সালে বড় ধরনের ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এছাড়াও, নিয়মিতই মৃদু ও স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সিলেট। তবে, ২০২১ সালে চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে ৭ বার ভূ-কম্পন সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।
আসামের এ ভূমিকম্প সিলেটের জন্য সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এগুলো স্বাভাবিক হলেও আসল উদ্বেগ লুকিয়ে আছে কপিলি ফল্টে জমে থাকা বিপুল শক্তিতে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জহির বিন আলম বলেন, “বাংলাদেশের মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এলাকাগুলো ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পপ্রবণ। কারণ এখানে বাংলাদেশ, মায়ানমার ও ইউরেশিয়ান তিনটি প্লেট রয়েছে। এই তিনটি প্লেটের মিলনস্থলেই বাংলাদেশের অবস্থিত। তাই এখানে ভূমিকম্পের সম্ভাবনাটা বেশি। তাই যেকোনো সময় এখানে বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে।”
পাশাপাশি এই অঞ্চলের তলদেশের মাটিগুলো নরম শিলা দিয়ে গঠিত, যা ভূমিকম্পের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে কখনো ভূমিকম্পের সঙ্গে মাটির যোগসাজশ তৈরি হলে, তখন বড় ধরনের কম্পন হতে পারে। যার মাত্রা হবে অনেক বেশি, যেখানে উদ্ধার তৎপরতাও কঠিন হতে পারে। তাই আমাদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে-জানিয়েছেন এই গবেষক।
তিনি আরও বলেন, ডাউকিতে অতীতে একাধিক ভূমিকম্প হয়ে শক্তি আংশিকভাবে বের হয়ে গেছে। কিন্তু কপিলিতে এখনো বিপুল শক্তি জমে আছে, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। জাপানের গবেষকরাও দীর্ঘদিন ধরে কপিলি ফল্ট নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত ডাউকির পাশাপাশি কপিলিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া।
ভৌগোলিকভাবে সিলেটের দক্ষিণ প্রান্তে ডাউকি ফল্ট এবং উত্তর-পূর্বে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কপিলি ফল্ট দুটিই সিলেটের কাছাকাছি অবস্থিত। ফলে এদের যে কোনো একটিতে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে সিলেট নগরী ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
সিলেট সিটি করপোরেশন-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ ও ২২ সালে কয়েক দফায় ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন। সিডিএমপি জরিপ চালিয়ে ঘোষণা করা হয়- সিলেটে বড় ভূমিকম্প হলে ৩০ হাজারের বেশি ভবন ধসের আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি নতুন নির্মিত দুই শতাধিক ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র না নেওয়ায় দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে এগুলো। ঝুঁকি বিবেচনায় ২০২১ সালে অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মাত্র ছয়টি বিপণিবিতান বন্ধ রং দিয়ে চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলার কথা জানিয়েছিল নগর কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে রং পাল্টে সেগুলো আজো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। উল্টো সিলেট নগরের ৪২ হাজার বহুতল ভবনের ভূমিকম্পের সহনীয়তা পরিক্ষার উদ্যোগও আটকে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সিলেটে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প এক প্রকার অ্যাটম বোমার মতো ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। তাতে সিলেটের ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।’ ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন না ভেঙে রেকটিফাইটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক দুযোর্গ সামাল দেওয়ার শক্তি মানুষের নেই। এরপরও ভূমিকম্প জোন হিসেবে কিছু আপডেট যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে সিলেটে। সেগুলো বিভাগের বিভিন্ন ফায়ার স্টেশনগেলোতে রাখা হয়েছে। অবশ্য কিছু ঘাটতি সবারই আছে। বিশেষ করে ভলেন্টিয়ার সার্ভিস এবং অফিসিয়ালি ভলেন্টিয়ার ৫/৭শ রয়েছেন। যদিও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অন্তত, ৫ হাজার জন।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপনে ৩৩ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন তথা ১০ তলা পর্যন্ত ভবনের উদ্ধারকাজ আগুন নেভানো সক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া সব দেশেই যত তলা ভবন, অগ্নি নির্বাপন সে তুলনায় অপ্রচুল।
সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আলী আকবর বলেন, সিসিক এলাকায় ১০ সহস্রাধিক ভবনের প্রস্তুতি থাকে। সেখানে সিলেটে ৬০/৭০ হাজার ভবন রয়েছে। তন্মধ্যে উচুঁ ভবন ৫ শতাধিক। আমরা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান লাগিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিরূপনে কাজ করছি। আর যারা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভবন তুলেছেন, সেগুলো ভাঙা হবে।
সিসিকের তথ্যমতে, নগরের বর্তমান আয়তন ৭৯ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালে সীমানা বর্ধিত করার পূর্ব পর্যন্ত আয়তন ছিল ২৬ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। পূর্বের আয়তনের তালিকাভুক্ত হোল্ডিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। তবে সীমানা বাড়ানোর পর ভবনের সংখ্যা আর জরিপ করা হয়নি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. জহির বিন আলম বলেন, সিলেট অঞ্চলের মাত্র ৩০ শতাংশ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়েছে। ৭০ শতাংশ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়নি। যা অনেক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো আমরা চিহ্নিত করে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছি। আমরা বিল্ডিংগুলো না ভেঙে সংস্কার করার পরামর্শ দিয়েছি। তবে তাদের এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।
শুক্রবার সংঘটিত ভূমিকম্প আমাদের আরও সর্তক থাকতে শিক্ষা দিয়ে গেছে। তাই আগামীতে পরিকল্পিত নগরায়ন ও বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করার পরামর্শ এ গবেষকের। সূত্র: বাংলানিউজ
আমার বার্তা/জেএইচ
