বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বন্যার ভয়াবহতা

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:০২ | অনলাইন সংস্করণ

  কমল চৌধুরী:

বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় হওয়ায় এবং বাংলাদেশের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত বিভিন্ন উপনদীর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই বর্ষাকালে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা হয়ে থাকে। সাধারণত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস বাংলাদেশে বর্ষা ঋতু। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান নদী ও উপনদীগুলো হিমালয়ের বরফগলা ও বৃষ্টির পানিতে তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হয় এবং বাংলাদেশ বন্যায় প্লাবিত হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্তিক গঠন ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ছোট বড় প্রায় ২৩০ টি নদী বয়ে গেছে। মূলত এজন্যই অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ বেশি। বন্যা সাধারণত মৌসুমী ঋতুতে হয়ে থাকে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর)। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা (১৮%) বন্যায় প্লাবিত হয়। অতীতে বন্যা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৪ সালে। অর্থ্যাৎ দেখা যায়,২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়ে ছিল। বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০২২ ও ২০২৪ সালে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক বন্যা হয।     

১৯৮৮ সালের বন্যা : ১৯৮৮ এর বন্যা ছিলো বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা ডুবে যায় এবং স্থানভেদে এই বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। এটি ছিলো এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষয়-ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিশ্বব্যাপী গণ-মাধ্যমেও সেই সময় এই দুর্যোগটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এর পরের সবচেয়ে বড় বন্যা হয় ২০২২ সালে। বাংলাদেশ এর সিলেট বিভাগে এই বন্যা হয়। সিলেট বিভাগের প্রায় ৮২% মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্তান করেন। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও অনেক বেশি ছিলো।
 

সংগঠিত হওয়ার কারণ :  এই প্রলংকারী বন্যাটি সংগঠিত হওয়ার মূল কারণ ছিলো সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (মাত্র তিন দিনে) দেশের তিনটি প্রধান নদীর পানি প্রবাহ একই সময় ঘটায়  নদীর বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হয়।

ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ: এই বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় ৮২,০০০ বর্গ কিমি (সমগ্র দেশের ৬০% এরও অধিক) এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয় : ১৯৮৬ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত সারফেস ওয়াটার সিমুলেশন মডেলিং প্রোগ্রাম  ১৯৮৮-র ভয়াবহ বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে  এর কারিগরী নির্দেশনায় সারফেস ওয়াটার মডেলিং সেন্টার  নামে পেশাদারী ইন্সটিটিউট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়; যা ২০০২ সালে ১ আগস্ট থেকে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং  নামে পরিচিতি লাভ করে।

১৯৮৮ সালের ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পরে বাংলাদেশ সরকার বন্যার কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের জন্য নেয়া ২৬টি বন্যা কর্মপরিকল্পনা (ফ্যাপ) সমীক্ষায় ইউএসএআইডি-এর কারিগরি সহায়তায় সম্পাদিত পরিবেশগত সমীক্ষা  এবং ভৌগোলিক তথ্য পদ্ধতি (জিআইএস) সমীক্ষা -র মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পানি খাতে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণের জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে 'ইজিআইএস প্রকল্প'-এ পরিণত হয় এবং নেদারল্যান্ড সরকারের কারিগরি সহায়তায় ২০০২ সালে 'সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস' (সিইজিআইএস) ট্রাস্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।


১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা: নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরনকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে একটি। এটি ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল বাংলাদেশে দক্ষিণপূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০কিমি/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়।

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ২২শে এপ্রিল, ১৯৯১ বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্মচাপের সৃষ্টি হয়। বাতাসে গতিবেগের ও নিম্মচাপের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি ২৪শে এপ্রিল ২০০২ই ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে এর শক্তি আরও বাড়তে থাকে। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা প্রচন্ড বৃদ্ধি পায় এবং গতিবেগ ১৬০  মাইল/ঘণ্টায় পৌছায় যা একটি ক্যাটাগরী-৫ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। ২৯শে এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তি অঞ্চলে ১৫৫ মাইল/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে যা  ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০শে এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়।

এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রাম জেলার উপকূল ও উপকূলীয় দ্বীপসমূহে। সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া ইত্যাদী দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। ১৯৭০ এর ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের পর অনেক সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হলেও সচেতনতা ও অজ্ঞাতার কারণে অনেকেই সাইক্লোনের মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে সেখানে আশ্রয় নেয়। অনেকেই ঝড়ের ভয়াবহতা বেশি হবে না এই আশায় আশ্রয় কেন্দ্রে উপস্থিত হয় নি। ধারণা করা হয় প্রায় ২০ লক্ষ লোক আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বিপদজনক স্থানে অবস্থানের কারণে ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়।

ধারণা করা হয় এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের (১৯৯১ মার্কিন ডলার) ক্ষতি হয়। সাগর ও নদীর উপকূল প্লাবিত হয়। কর্নফুলি নদীর তীরে কঙ্ক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলচ্ছাসে ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১০০টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয় এবং আঘাতের কারণে টুকরো টুকরো অংশে বিভক্ত হয়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান ও আকাশ নিখোজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও বিদ্যমান। প্রায় ১০ লক্ষ ঘড়-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এতে ১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।  

১৯৯৮  সালের বন্যা ছিলো বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়ংকর বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুই মাসের অধিককাল জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়।[১]
সংগঠিত হওয়ার কারণ:  এই ভয়ংকর বন্যাটি সংগঠিত হওয়ার মূল কারণ ছিলো সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (মাত্র তিন দিনে) দেশের প্রধান তিনটি নদীর পানি প্রবাহ একই সময় ঘটায় ও ব্যাক ওয়াটার এ্যাফেক্টের কারণে নদীর বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি প্রাহিত হয়।
ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ: সারাদেশের দুই- তৃতীয়াংশ ভূমি প্লাবিত হয়েছিল।

২০২৪ সালে বন্যা: ফারাক্কা বাঁধ হচ্ছে বাংলাদেশের বড় দুঃখ। শুস্ক মৌসুমে ভারত ফারাক্কার সকল বাঁধ বন্ধ করে দিয়ে পানি আটকে রাখে।ফলে পানিশুন্যতার কারণে আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা শুকিয়ে মরুভ’মিতে পরিণত হয়।  আর বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেটের সবগুলোই খুলে দেয় ভারত।যার জন্য বাংলাদেশে প্রতি বর্ষা মৌসুমে বন্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।অতি সম্প্রতি ভারত ফারাক্কার সকল গেট খুলে দিয়েছে। বিহারের গঙ্গায় পানির স্তর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কার এই গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ভারত সরকার।

গত কয়েক দিন ধরেই বড় ধরনের বন্যায় ভাসছে বাংলাদেশের ১১টি জেলা। দেশের পূর্বাঞ্চলে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই ১১ জেলায় ৫৭ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।তা ছাড়া এ বন্যায় ৩০ জন লোক মারা যায়। বাংলাদেশের এই বন্যার জন্য বিভিন্ন জন ভারতকে দায়ী করছেন। বলা হচ্ছে, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এবার ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দেওয়ায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় কিনা এরকম শঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের পানি ডেঞ্জার লেভেল পার করায় ছাড়া হচ্ছে। বছরের বাকি সময়ে আপ স্ট্রিমে পানি যেমন থাকে সেই অনুযায়ী ছাড়া হয় ডাউন স্ট্রিমে। গঙ্গার পানির স্তর বৃদ্ধি হতেই ১১ লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে। তারা আরও জানায়, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বিপুল পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের পানির স্তর বাড়ায় সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। যে পরিমাণ পানি আসছে সেই পরিমাণ পানি ছাড়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই ৭৭.৩৪ ডেঞ্জার লেভেল অতিক্রম করেছে। বিহার, ঝাড়খণ্ডসহ গঙ্গার উচ্চ অববাহিকায় ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে হু হু করে বাড়ছে গঙ্গার পানির স্তর। ফারাক্কা ব্যারেজের আপ স্টিমে জল ধারণ ক্ষমতা ২৬.২৪ মিটার। বিপদসীমা ২২.২৫ মিটার এবং সর্তকতা সীমা ২১.২৫ মিটার। ইতোমধ্যে আপ স্টিমের ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করায় গত শনিবার থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে অধিকাংশ গেট। ইতোমধ্যেই ১১ লাখ কিউসেকের বেশি পানি ছাড়া হচ্ছে ব্যারেজ থেকে। প্রচুর পানি বইছে বাংলাদেশের দিকে। তবে তাতে কোনও শঙ্কা দেখছেন না বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন বন্যাকবলিত জেলাগুলো পূর্বাঞ্চলে। ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খুলে দেওয়ায় গঙ্গা নদীর পানি বাড়বে। বর্তমানে গঙ্গার পানি বিপদসীমার এক থেকে দেড় মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়লেও সেটি খুব বেশি বাড়বে না। ফলে এখনও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন করে বন্যার কোনও শঙ্কা দেখছি না।’ ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেটের সবগুলো খোলা থাকলেও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানাচ্ছে দুই দেশ। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ফারাক্কার ভারতের অংশে এই মুহূর্তে বন্যা পরিস্থিতি চলছে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই।বর্ষাকালে ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেট খোলাই থাকে। এগুলো আটকে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে জানান তারা। অন্যদিকে, একই কথা বলছে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প। তারা বলছে, বাঁধ থেকে ভাটির দিকে যে পানি ছাড়া হচ্ছে, তাতে এখনই বন্যার আশঙ্কা নেই।   

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে গত কয়েকদিন ধরে যে আকস্মিক বন্যা হচ্ছে তখনও সরকারসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে ভারতের ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে বন্যা হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু, সে সময় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছিল এ আকস্মিক বন্যার পূর্ব ধারণা ছিল। তবে এতো ব্যাপক মাত্রায় বন্যা হবে সেটি ধারণা ছিল না সরকারের। গত সোমবার ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেটের সবগুলোই খোলা রয়েছে এমন খবর প্রকাশিত হলে আবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়। বলা হচ্ছে, ভারত ফারাক্কা বাঁধের গেট খোলার ফলে এখন আবার বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ অত্র অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে।

কিন্তু, এ ধরনের শঙ্কা একেবারে নাকচ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। বন্যা নিয়ে যে পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এবং বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র  গত সোমবার যে পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে গেছে। এতে আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এ সংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। একইসাথে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীর পানি হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের পূর্বাঞ্চল ও এ সংলগ্ন উজানে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি হ্রাস পেতে পারে। উন্নতি হতে পারে নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির। একইসাথে ফেনীর নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে পারে। তবে, কোনো কোনো স্থানে স্থিতিশীল থাকার পূর্বাভাসও দিচ্ছে সতর্কীকরণ কেন্দ্র। পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান স্বাক্ষরিত এ পূর্বাভাসে আরো বলা হচ্ছে, ব্রক্ষপুত্র-যমুনা এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে।

উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ আছে যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকত পারে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা নেই’ ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বন্যা পরিস্থিতির কারণে ফারাক্কা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিয়েছে দেশটি। তবে বাংলাদেশের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া  গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এতে বাংলাদেশের আশঙ্কার কারণ নেই। তেমন কোনো বৃষ্টিপাত নেই। বৃষ্টিপাত হলেও তাতে আমাদের বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই। “ফারাক্কার উজানে ভারতীয় অংশে এই মুহূর্তে বন্যা চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে বন্যার আশঙ্কা এই মুহূর্তে নেই। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি এখন সমতলে একদম স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। এজন্য এখন এ মুহূর্তে বন্যার আশঙ্কা করছি না,” বলেন মি. বড়ুয়া। ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেটের সবগুলো খোলা থাকার বিষয়ে মি. বড়ুয়া বলেন, “ফারাক্কা কিন্তু আসলে পানি আটকে রাখে না। পানি ডাইভার্ট করে। আমরা বলি ডাইভারশন স্ট্রাকচার। অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে তারা পানিগুলো ডাইভার্ট করে নিয়ে যায়।”বর্ষাকালে এ বাঁধের সবগুলো গেট খোলা থাকে বলে জানান মি. বড়ুয়া।

“বর্ষাকালে ফারাক্কা সাধারণত খোলাই থাকে। এ মুহূর্তে উজানের যে অবস্থা অবশ্য আমাদের কাছে শতভাগ নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে আমরা হাইড্রোলজি বা বিজ্ঞান মতে যেটা বুঝে থাকি এ মুহূর্তে ফারাক্কার গেইট সবগুলো খোলা আছে। অর্থাৎ গেইট খুলে দিয়ে বন্যা হয়ে যাওয়ার এমন কোনো সিচুয়েশন ফারাক্কাতে নেই। ফারাক্কার ১০৯টি গেইট খোলা আছে। বর্ষাকালে এগুলো সবসময় খোলাই থাকে। বর্ষাকালে এগুলো আটকে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কবি।

আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই