শেষ পর্যন্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলেন ইশিবা শিগেরু

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫৪ | অনলাইন সংস্করণ

  রায়হান আহমেদ তপাদার

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা গত মাসে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এর পর থেকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত কে হতে পারেন, তা নিয়ে গুঞ্জনে মুখর ছিল জাপান। সেই গুঞ্জন শেষ হয়েছে। ফুমিও কিশিদার উত্তরসূরি নির্বাচিত হয়েছেন ইশিবা শিগেরু। পাঁচবারের প্রচেষ্টার পর লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। অতীতে জাপানের প্রধান ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপির নেতৃত্ব পেছনের দরজার দেনদরবারের মধ্য দিয়ে বেছে নেওয়ার ইতিহাস রয়েছে।৬৭ বছর বয়সী ইশিবাকে জাপানের অনেকে স্কটল্যান্ডের অতীতের নেতা রবার্ট ব্রুসের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এর পেছনে রয়েছে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার নির্বাচনে এর আগে পাঁচবার পরাজিত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত তাঁর ফিরে আসা। ভোটের ফলাফল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান এবং গভীর কৃতজ্ঞতা বোধের চিহ্ন হিসেবে বারবার মাথা নত করে ফলাফল মেনে নেন। এরপর দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ইশিবা বলেছেন, জাপানকে এ রকম এক রাষ্ট্রে পরিণত করে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা তিনি করে যাবেন, সবাই যেখানে নিশ্চিত ও নিরাপদ পরিস্থিতিতে মুখে হাসি নিয়ে জীবন যাপন করতে পারবেন। অনেক প্রচেষ্টার পর জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ইশিবা শিগেরু। তাঁকে প্রতিরক্ষা নীতি সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একসময় তিনি কেবল জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বই পালন করেননি, দীর্ঘ সময় ধরে দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের সদস্য থাকা অবস্থায় দেশের প্রতিরক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়াতে সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর জাপানের প্রতিরক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ যে নেবেন, অনেকেই সেটা স্বাভাবিক হিসেবে দেখেছিলেন।প্রতিরক্ষা খাতকে শক্তিশালী করাই কেবল নয়, একই সঙ্গে আঞ্চলিক ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করে নিতেও একই রকম উৎসাহ ইশিবার মধ্যে সব সময় দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে দেওয়া এক বক্তব্যে উত্তর আটলান্টিক শান্তি চুক্তি ন্যাটোর অনুকরণে এশিয়া মহাদেশের জন্য নতুন একটি ন্যাটো জোট গড়ে নেওয়া নিয়ে বক্তব্য দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাছায়ার ভেতরে অবস্থান করা নিয়ে ইশিবা সন্তুষ্ট। সেই অবস্থান ধরে রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর। ইশিবা স্বীকার করেন যে তিনি জাপান-যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা জোটের দৃঢ় সমর্থক। তবে জোটকে সমতাপূর্ণ অংশীদার করে তোলার প্রচেষ্টার কথাও তিনি জানিয়েছেন। তবে প্রাথমিক এসব পদক্ষেপ শক্তিশালী জাপান গড়ে নেওয়ায় কতটা সহায়ক হবে, তা অবশ্য এখন আরও বেশি অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমতাপূর্ণ জোট গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা ইশিবা ব্যক্ত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর বাধার মুখে শুরুতেই সেটাতে পড়তে হচ্ছে। ওয়াশিংটন পরোক্ষে হলেও স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে যে সামরিক বাহিনীর অবস্থানসংক্রান্ত চুক্তি বদল করে নেওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। আর সেই চুক্তির সংশোধন ছাড়া সমতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা যে অধরাই থেকে যাবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। অন্যদিকে এশিয়ার ন্যাটো গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা ইশিবা ব্যক্ত করেছেন, তা নিয়েও এখন সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুরুতেই এর বিরোধিতা করে বলেছেন, সে রকম কোনো জোটে যোগ দিতে নয়াদিল্লি আগ্রহী নয়।


অন্যদিকে একমাত্র ফিলিপাইন ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশও ন্যাটোর অনুকরণে আঞ্চলিক একটি জোট গঠনের ধারণার সঙ্গে একমত নয়। এর প্রধান কারণ অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ে আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে চীনের গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।অর্থনৈতিক দিক থেকে চীন এখন আর জাপানের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই এবং অঞ্চলজুড়ে আছে চীনের বিশাল বিনিয়োগ। এর ফলে সেই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে এরা কেউ রাজি নয়। এশিয়ার ন্যাটো গড়ে তোলার ধারণার পেছনে যে আছে চীনকে প্রতিহত করতে পারার আকাঙ্ক্ষা, সেটা এখন আর অলীক কোনো ভাবনা নয়। এর ফলে এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ মনে করছে, ন্যাটোর অনুরূপ জোট গড়ে তোলা হলে এবং সেই জোটে তারা যোগ দিলে দ্রুতই সেসব দেশ চীনের বিরাগভাজন হয়ে উঠবে। এশিয়ার দেশগুলো আরও মনে করছে, এসব থেকে দূরে সরে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আর তাই ইশিবার এশিয়ার ন্যাটো গড়ে তোলার ভাবনা বাস্তবায়িত হলে শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ফিলিপাইনের বাইরে অন্য কোনো দেশ এতে যোগ দিচ্ছে না। জাপানও এই বাস্তবতা এখন আঁচ করতে পারছে। ফলে বুঝাই যাচ্ছে, প্রতিরক্ষা নীতিমালার দিক থেকে বড় রকমের হোঁচট খাওয়ার মধ্যে দিয়ে দায়িত্বপালন শুরু করলেন জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী।এমন এক সময় ইশিবা দলনেতার দায়িত্ব নিলেন, যখন বড় সংকটের মধ্যে রয়েছে এলডিপি। বিভিন্ন কেলেঙ্কারির জের ধরে দলে বিভক্তি দেখা দিয়েছে, নজিরবিহীনভাবে কমেছে জনপ্রিয়তা। এমনই এক পরিস্থিতিতে গত মাসে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। এরপর ভোটাভুটির মাধ্যমে ইশিবাকে নতুন নেতা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। তবে তাঁর জন্যও রয়েছে নানা রকম চ্যালেঞ্জ।

এর মধ্যে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের দলীয় আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ কেলেঙ্কারিতে সমালোচিত এলডিপির হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার বাইরে আরও আছে অর্থনৈতিক সমস্যার চক্র থেকে জাপানকে বের করে আনা এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কে তৈরি হওয়া জটিলতা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারা। কিন্ত কতটা সফল তিনি হবেন, এর অনেকটাই নির্ভর করবে দলের ভেতরে নিজের সমর্থনের ভিত্তি শক্তিশালী করে নেওয়ার ওপর। এলডিপির নেতাদের মধ্যে জনসমর্থনের দিক থেকে ইশিবা অনেকাংশে এগিয়ে থাকলেও দলের ভেতরে, বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের মধ্যে তাঁর সমর্থন অনেকাংশেই দুর্বল।ইশিবা এমন এক সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, যখন এ অঞ্চলে দিন দিন আগ্রাসী হয়ে উঠছে চীন। পশ্চিমা বলয়ের বিপরীতে অবস্থান করা রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে বেইজিং।।এমনকি সম্প্রতি জাপানের দুটি দ্বীপের মধ্যে প্রবেশ করেছিল চীনের যুদ্ধজাহাজ। এমন পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত হুমকিগুলো নিয়ে তৎপর থাকতে হবে ইশিবাকে। চীনকে সামাল দিতে জাপানের সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা এবং পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মতো এশিয়াভিত্তিক একটি জোট গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে পারেন তিনি। একই সঙ্গে চীন সংক্রান্ত মন্তব্য করার সময় সতর্ক থাকতে হবে তাঁকে। সতর্কতার কথা বলা হচ্ছে কারণ, ইশিদা এলডিপির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায় তাঁর দেশ।কারণ,চীন ও জাপানের সম্পর্কের গভীর,দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল উন্নয়ন হলে তা দুই দেশের মানুষের মৌলিক স্বার্থগুলো রক্ষা করবে। নিজ দেশে ইশিবাকে অর্থনীতিতে সুবাতাস ফেরাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের কারণে জাপানের মুদ্রা ইয়েনের দাম পড়ে গেছে।

যদিও ইশিবা দলনেতা নির্বাচিত হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়েছে। প্রতি ডলারের বিপরীতে এখন ১৪২ দশমিক ৯৪ ইয়েন পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে ১ ডলারে ১৪৬ দশমিক ৪৯ ইয়েন পাওয়া যাচ্ছিল। এ ছাড়া জাপানের গ্রামীণ অঞ্চলের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইশিবা।দেশটির দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য একটি সরকারি সংস্থা গড়ে তোলার কথাও বলেছেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে যাওয়া ইশিবার ওপর ভরসা রাখছেন অনেকে। কারণ, তিনি যা মনে করেন, তা করে দেখানোর সাহস রয়েছে তাঁর। তবে প্রতিরক্ষার বিষয়ে ইশিবার নেতৃত্বে জাপান আরও ডানপন্থী হয়ে উঠুক,এটা অনেকেই চান না। তবে প্রতিরক্ষা নীতির বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখা হয় ইশিবাকে।একসময় তিনি পশ্চিমা সাসরিক জোট ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ গড়ে তোলার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা জোটের সমর্থক হলেও তিনি জোটকে আরও বেশি সমতাপূর্ণ করে তুলতে আগ্রহী। ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিকো নাকাবায়াশি বিবিসিকে বলেন, 'মানুষ এখনকার মূল্যস্ফীতি নিয়ে হতাশ। জাপানি মুদ্রার মান কমে গেছে, মূল্যস্ফীতির সাথে সাথে অনেক আমদানিপণ্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।'এলডিপির জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাপানের বার্ধক্য ও ক্রমেই কমতে থাকা জনসংখ্যা, যা সামাজিক ও চিকিৎসা সেবা ওপর চাপ তৈরি করছে। এটি দেশের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মশক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপান কীভাবে তার শ্রমবাজার পরিচালনা করবে এবং অভিবাসন নিয়ে মনোভাব বদলানো উচিত কি না, তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে এলডিপি সরকারকে। ২০২৫ সালের অক্টোবর নাগাদ জাপানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই এলডিপির জন্য এসব চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে সাধারণ নির্বাচনকে এগিয়ে আনার দাবিও রয়েছে। কিন্ত এখন দেখার বিষয় হচ্ছে নতুন প্রধানমন্ত্রী ইশিবা জাপানকে কোনদিকে এগিয়ে নিয়ে যান।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।

আমার বার্তা/জেএইচ