বিশ্ব রাজনীতির রূপরেখা: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫০ | অনলাইন সংস্করণ

  রহমান মৃধা:

বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক পরিসরে প্রবাহিত হচ্ছে, যেখানে প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ ও কৌশল অনুসরণ করে আলাদাভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তিধর দেশ ও আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের ভূমিকা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনগুলো বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রবাহকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এই প্রেক্ষাপটে, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া এবং আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থা ও বাংলাদেশের ভূমিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হবে।

১। আমেরিকার বর্তমান গণতন্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বিভিন্ন সংকটে পড়েছে। বিশেষত, দ্বিদলীয় মেরুকরণ, ভোট কারচুপি অভিযোগ এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো সামনে এসেছে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়, যদিও অধিকাংশ অভিযোগ তদন্তে খণ্ডিত হয়। এর ফলে গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকান জনগণের আস্থা কিছুটা কমেছে।

গণতান্ত্রিক সমস্যার কিছু প্রধান দিক:

• নির্বাচনী নিরাপত্তা: ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে, ভোট কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। যদিও বিচার বিভাগ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার বলেছে যে নির্বাচনে কোনো বড় ধরনের অনিয়ম হয়নি, তবুও ৩৫ শতাংশ রিপাবলিকান ভোটার মনে করেন যে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কারচুপি হয়েছে।

• গণতন্ত্রের মেরুকরণ: রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেড়েছে, যার ফলে আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।


• ভোটার উপস্থিতি: ২০২০ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৬.৮%, যা আমেরিকার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যদিও এই নির্বাচনটি গণতান্ত্রিক সক্রিয়তার দিক থেকে ইতিবাচক ছিল, তবে বিভাজন ও বিতর্কের পরিমাণও বেশি ছিল।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

আমেরিকা তার বৈশ্বিক নেতৃত্ব বজায় রাখতে এবং আধুনিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে একটি সুসংহত কৌশল গ্রহণ করছে। দেশটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি করার জন্য নতুন নীতি গ্রহণ করছে। পাশাপাশি, বৈশ্বিক অঙ্গনে কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ন্যাটো এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে সহযোগিতার দিকে নজর দিচ্ছে।

২. চীনের নেতৃত্ব ও বিশ্ব প্রভাব

চীন তার একদলীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে, যা তাকে একটি বৈশ্বিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে চীন আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে চীন এশিয়া, আফ্রিকা, ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অবকাঠামোগত ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যা তাকে একটি গ্লোবাল শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

তবে, চীনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর সমালোচনা রয়েছে:

• মানবাধিকার লঙ্ঘন: বিশেষ করে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দমনের ঘটনা বিশ্বজুড়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলি চীনের আন্তর্জাতিক ইমেজকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার জন্ম দিচ্ছে।

• আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উত্তেজনা: চীনের দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে টানাপোড়েন সৃষ্টি করছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চীন তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে, দেশটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে বৈশ্বিক যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার লক্ষ্য রাখছে। এছাড়াও, চীন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং সবুজ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করছে, যেন এটি একটি শক্তিশালী এবং টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে।

৩. আরব জাতির রাজনীতি

আরব দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরশাসন এবং মৌলিক রাজনৈতিক সংঘাতের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০১১ সালের আরব বসন্ত আন্দোলন অনেক দেশে গণতন্ত্রের আশা জাগালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে। পরিবর্তে, এই অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাত আরও ঘনীভূত হয়েছে, যা আরব দেশগুলোর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।

বড় আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থা:

• সৌদি আরব: সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ, যা তার বিশাল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের অধীনে কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার আনা হয়েছে, যেমন “ভিশন ২০৩০” পরিকল্পনা, যা তেল নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তির মাত্রা খুব সীমিত, যেখানে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ কম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হয়েছে।

• মিশর: ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর মিশরে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা তৈরি হলেও, ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থান সেই সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দেয়। প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির শাসনামলে দেশে আবার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ফিরে এসেছে, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে এবং বাকস্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করা হয়েছে। মিশর এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তবে তার আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক অবস্থান অটুট রয়েছে।

• ইয়েমেন: ইয়েমেনের রাজনৈতিক অবস্থা বর্তমানে সবচেয়ে মারাত্মক। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, যেখানে সৌদি আরব এবং ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই যুদ্ধের ফলে দেশটি একটি মানবিক সংকটে পড়েছে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষ এবং স্বাস্থ্য সেবার সংকটে ভুগছে। দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কেবল যুদ্ধের সমাপ্তির ওপরই নির্ভরশীল নয় বরং বৈদেশিক শক্তির প্রভাব এবং ভেতরকার সংঘাত নিরসনের ওপরও নির্ভরশীল।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

আরব দেশগুলো রাজনৈতিক সংস্কার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য একত্রিতভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর মতো উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং যুব সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন লক্ষ্য করা হচ্ছে। এছাড়াও, অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আরব লীগ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনের সাথে যৌথ প্রচেষ্টা চলছে।

৪. রাশিয়ার স্বৈরশাসন

রাশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনের অধীনে কেন্দ্রীভূত। ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন উপায়ে ক্ষমতায় থাকার মাধ্যমে পুতিন রাশিয়ার রাজনীতিকে কার্যত একদলীয় শাসনে পরিণত করেছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমন, রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর নির্যাতন এবং নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন তার শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে, অনেকেই তার শাসনব্যবস্থাকে স্বৈরাচারী হিসেবে বিবেচনা করেন।

• ইউক্রেন আক্রমণ: ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, পুতিন তার অভ্যন্তরীণ শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তার শাসনের সমর্থকগোষ্ঠী তাকে শক্তিশালী নেতা হিসেবে দেখছে, যিনি পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করছেন।

• সামরিক প্রভাব: রাশিয়ার বিশাল সামরিক শক্তি তাকে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব এবং ইউক্রেন সংঘাতের ফলে রাশিয়ার কূটনৈতিক অবস্থান সংকটময় হয়ে উঠেছে। ন্যাটো এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও শীতল হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে পারে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

রাশিয়া সামরিক আধুনিকীকরণের দিকে মনোনিবেশ করছে এবং নতুন আন্তর্জাতিক বাজারের খোঁজে রয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখতে চায়।

৫. ভারতের অবস্থান

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত তার সাংবিধানিক ভিত্তি এবং বহুমাত্রিক সমাজের ওপর নির্ভর করে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অবস্থান ধরে রেখেছে। যদিও ভারত একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যেমন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘটনাগুলো ভারতের গণতন্ত্রের সলিনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (NRC) প্রক্রিয়া সংখ্যালঘুদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, যা আন্তর্জাতিক মহলেও সমালোচনার মুখে পড়েছে। ভারতের এই নীতিগুলো কেবল দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে না বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও এর সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ, নেপাল, ও শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশগুলোর সাথে ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে এই নীতিগুলো এই দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে।

ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবশালী অবস্থান বজায় রাখতে হলে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ভারতকে আরও সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, আঞ্চলিক সম্পর্কেও ভারসাম্য রক্ষা করে চলা ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি, যাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা বজায় থাকে এবং অঞ্চলটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যেতে পারে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ভারত তার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শক্তিশালী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে নজর দিচ্ছে। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার লক্ষ্য রাখছে। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে ভারত পরিবেশগত সুরক্ষা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৬. ইউরোপের গণতন্ত্র

ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ গণতান্ত্রিক হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে, ব্রেক্সিট, উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান এবং অভিবাসন সংকট ইউরোপীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

• ব্রেক্সিট: যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই প্রক্রিয়া EU-র অভ্যন্তরীণ বিভক্তি বাড়িয়ে তুলেছে এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

• উগ্রপন্থার উত্থান: ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র ডানপন্থী দলের উত্থান এবং তাদের অভিবাসন নীতি নিয়ে বিতর্ক গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এই উগ্রপন্থী দলগুলো জনপ্রিয়তা অর্জনের ফলে সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ইউরোপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটি সুসংগঠিত ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের দিকে মনোনিবেশ করছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, সামাজিক সমন্বয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কৌশল উন্নয়নের দিকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো অভিবাসন সংকট, উগ্রপন্থা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একত্রিত হয়ে কাজ করার জন্য একটি টেকসই কৌশল গ্রহণ করছে।

এই পরিকল্পনাগুলোর মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলো তাদের বৈচিত্র্যময় সমাজে সংহতি এবং সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ইউরোপ বিশ্ব মঞ্চে তার প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

৭. ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

বিশ্ব রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভবত আরও বহুমেরুকৃত হয়ে উঠবে, যেখানে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, এবং ইউরোপের পাশাপাশি উদীয়মান দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ক্রমশ বাড়তে থাকবে, বিশেষ করে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, এবং লাতিন আমেরিকা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

৮. বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মূলত বস্ত্রশিল্প, রেমিট্যান্স, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের GDP প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬%, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। সরকার “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এবং ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

তবে এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা, এবং মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেছে। এসব চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য বড় অন্তরায় হতে পারে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে ভারত, চীন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ছাড়া এই অগ্রগতি টেকসই হবে না।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাংলাদেশকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং স্বৈরাচারী শাসনের উত্তরাধিকার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসকের পতন এবং নতুন প্রজন্মের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই সরকার যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের পথে অটলভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।

এই পরিবর্তনগুলো টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। দেশের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করা জরুরি। এ ধরনের সমন্বিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে সহায়ক হবে।


লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

আমার বার্তা/জেএইচ