বিগত সরকারের উন্নয়নের নামে সাদা হাতি প্রকল্প
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৪ | অনলাইন সংস্করণ
মো. জিল্লুর রহমান:
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব অস্বাভাবিক খরচের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল তার মধ্যে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল একটি, যেটি কর্ণফুলী টানেল নামে সকলের কাছে সমধিক পরিচিত। প্রায় ১০,৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প শুরুতেই বিপুল অঙ্কের যে লোকসান গুনছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর এই টানেলটি উদ্বোধনের পর থেকে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা খরচের বিপরীতে আয় হচ্ছে মাত্র ১০.৩৭ লাখ টাকা এবং এই বিশাল প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরকারের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৭.০৯ লাখ টাকারও বেশি, অর্থ্যাৎ এই টানেল থেকে গড়ে প্রতিদিন যে টাকা আয় হচ্ছে থেকে তার চেয়ে ব্যয় প্রায় চারগুণ বেশি। টানেল কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালে টানেল উদ্বোধনের পর ২০২৪ সালে গড়ে প্রতিদিন ১৮,৪৮৫টি গাড়ি চলাচল করবে বলে সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু ২০২৪ এর অক্টোবরে এসে দেখা যাচ্ছে গড়ে প্রতিদিন গাড়ি চলাচল করছে মাত্র ৩,৯১০টি, যা প্রকাশিত সমীক্ষার চেয়ে চার ভাগের একভাগেরও কম। আসলে তখন এই প্রকল্পটির যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য একটা অবাস্তব ও কাল্পনিক সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছিল, যার সাথে বাস্তবতার কোন মিল ছিল না।
একইভাবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয় গত বছরের ১ ডিসেম্বর। বর্তমানে এ রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দুটি ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আরেকটি ট্রেন চলছে। সব মিলিয়ে এ পথে ট্রেন চালিয়ে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি টাকা আয় করেছে, বিপরীতে ট্রেনগুলো পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। লাভের পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু ১০১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ প্রকল্পটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে নির্মাণ করা হয়েছে এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধ ২০২২ সাল থেকে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও এডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বার্ষিক প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৪২০ কোটি টাকার সমপরিমাণ) হারে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০২৮ সালে এ কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে বার্ষিক প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ডলার। ঋণের কিস্তির সঙ্গে প্রায় ২ শতাংশ সুদ আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হবে এবং এ প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণ ২০৪৮ সাল পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে চার থেকে ছয় লেনের মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, রেলপথ, রেল সেতু, বিমানবন্দরের টার্মিনালের মতো যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই নির্মাণ ব্যয় গোটা পৃথিবীতে সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বা অন্যতম সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থার পর্যালোচনার হিসাবেও বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে, দেশের সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্পগুলোর একটি পদ্মা সেতু। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ৩২,৬০৫ কোটি টাকা। এ খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতুটি নির্মাণে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি অর্থ খরচ হয়েছে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উল্লেখযোগ্য সাদা হাতি প্রকল্প।
বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের ইতিহাসে টাকার অংকে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যত ‘নন-আরবান হেভি রেল’ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তার মধ্যে এ প্রকল্পের কিমি প্রতি নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি। একইভাবে প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঢাকার ‘এমআরটি লাইন-৬’। ঢাকার দ্বিতীয় (এমআরটি লাইন-১) ও তৃতীয় (এমআরটি লাইন-৫, নর্দান রুট) মেট্রোরেলের কিমি প্রতি নির্মাণ ব্যয় আরো বেশি। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কিমি প্রতি নির্মাণ ব্যয় ২০০ কোটি টাকার বেশি, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল।
পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে আট লেনের জাতীয় বা প্রাদেশিক মানের এক কিমি সড়ক নির্মাণে খরচ হয় প্রায় ১৫ লাখ ডলার। জেলা ও শহরাঞ্চলের জন্য দুই লেনের প্রতি কিমি সড়ক তৈরিতে ব্যয় হয় প্রায় ৬ লাখ ডলার এবং প্রান্তিক সড়কের ক্ষেত্রে প্রতি কিমিতে নির্মাণ ব্যয় পড়ে প্রায় ৪ লাখ ডলার। ভারত সঠিক পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, দক্ষ জনশক্তি, নির্মাণ উপকরণ ও যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানাবিধ কারণে এশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে কম খরচে সড়ক তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক উল্টো চিত্র। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এখানে প্রতি কিমি চার বা ততোধিক লেনের সড়ক নির্মাণ করতে ২৫ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার জন্য উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক।
শুধু সড়কই নয়, মেট্রোরেলের নির্মাণেও অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। ঢাকার প্রথম মেট্রো নির্মাণে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, ভারতের দিল্লিতে তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে প্রথম মেট্রো তৈরি হয়। পাকিস্তানও ঢাকা এমআরটি-৬ এর অর্ধেকেরও কম খরচে লাহোরে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে। অন্যদিকে চীন এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে। দেশটির সাংহাই শহরের প্রথম মেট্রোটির নির্মাণ ব্যয় ঢাকার এমআরটি-৬ এর নির্মাণ ব্যয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ঢাকার চেয়ে কম খরচে দুটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে ভিয়েতনামের দুটি শহরে। ঢাকায় নির্মাণাধীন দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় আরো বেশি।
যমুনা নদীতে বিদ্যমান সেতুর সমান্তরালে নির্মিত হচ্ছে একটি রেল সেতু। ৪.৮০ কিমি দীর্ঘ এ রেল সেতু নির্মাণে কিমি প্রতি ব্যয় পড়ছে ৩,৪৯৬ কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, কিমি প্রতি ব্যয়ের দিক থেকে এ অংক প্রতিবেশী ভারত ও চীনের দীর্ঘ ও বৃহদায়তনের রেল সেতুগুলোর চেয়েও অনেক বেশি। অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এ খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশে যতগুলি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে তার সব ক্ষেত্রেই প্রকল্প ব্যয় ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে দেখানোর এক ধরনের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। প্রকল্পগুলোর ব্যয় এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যেন সেগুলো মেগা আকৃতি ধারণ করে, নিজস্ব লোকজনের মধ্যে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব বন্টন করে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। অথচ এ ব্যয়টা হওয়ার কথা ছিল গবেষণা ও বাস্তব ভিত্তিক। কীভাবে কম খরচে ভালো অবকাঠামো তৈরি করা যায় সেই চেষ্টা গত সরকারের সময়ে একদম ছিল না।
আশপাশের দেশগুলো কম খরচে অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারলে বাংলাদেশ কেন পারছে না, এ প্রশ্নের জবাবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, মহাসড়ক, রেলপথ নির্মাণের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং এখনো যেগুলোর কাজ চলমান, সেগুলোর কারিগরি মান আশপাশের দেশে বাস্তবায়িত সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর মতোই। কিন্তু আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিগত সরকার যে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় করেছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ ব্যয়ে আশপাশের দেশগুলো একই প্রকল্প করেছে। আশপাশের দেশগুলো যদি কম খরচে মেট্রোরেল, সড়ক, সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারব না, এটা একটা বড় প্রশ্ন। এক্ষেত্রে, যেখানে বিনিয়োগটা ভারী ও খরচ অস্বাভাবিক হয়, সেখানে যারা ব্যক্তিগতভাবে প্রকল্প থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ইতোমধ্যে বিগত সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের চিত্র ধীরে ধীরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের নামে অস্বাভাবিক ব্যয়ের সাদা হাতি নামের মেগা প্রকল্পের দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে লাগামহীনভাবে ঋণ নিয়ে জনগণের ওপর বোঝা চাপানোর ঘটনায় বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। শেখ হাসিনা তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আমলেই নেননি, বরং কখনও কখনও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তাদের বিদ্রুপ করেছেন। তিনি নিজের একক সিদ্ধান্ত ও তোষামোদকারীদের উৎসাহে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও ঋণ গ্রহণে উৎসাহী ছিলেন। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যেসব প্রকল্প নিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে—রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি। এসব প্রকল্পের জন্য ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তের উচ্চ হারের স্বল্পমেয়াদী ঋণ নিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে ডুবিয়ে গেছেন। দেশের অর্থনীতিকে ঋণের ফাঁদে ফেলে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন গত সাড়ে ১৫ বছরে উন্নয়নের নামে যেসব সাদা হাতির মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার সবগুলোই অর্থ আত্মসাৎ ও লুটপাটের দিকটি সামনে রেখে নেওয়া হয়েছিল।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
আমার বার্তা/জেএইচ