ভূপৃষ্ঠের প্রাণ জলাভূমিকে রক্ষা করতে হবে

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৮ | অনলাইন সংস্করণ

  মো. জিল্লুর রহমান:

২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০০টিরও বেশি দেশের পরিবেশ সচেতন নাগরিকরা এই দিবসটি পালন করে আসছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধ আধার হলো জলাভূমি। এজন্য জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের এই দিনে ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী সম্মেলনে জলাভূমির টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই হয়। যা রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে রামসার কনভেনশন চুক্তি কার্যকর হয়। এখন পর্যন্ত ১৭২টি দেশ এ চুক্তি অনুমোদন করেছে এবং পৃথিবীর ২৫,৬১,৯২,৩৫৬ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ২,৪৭১টি স্থান আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো রামসার কনভেনশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে।

বাংলাদেশ ১৯৯২ সালে রামসার কনভেনশন চুক্তিতে সই করে। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশকে ঘিরে রেখেছে। বাংলা পিডিয়ার তথ্যমতে, এ দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত যা আমাদের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জলাভূমি। আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশে রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য। ১৯৯২ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক ও লীলাভূমি সুন্দরবনকে প্রথম ও ২০০০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান (রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জলাভূমি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

একসময় প্রবাদ ছিল, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ কিন্তু ধীরে ধীরে জলাশয় ভরাট হওয়ায় আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালীর পুরানো গৌরব হারিয়ে ফেলতে বসেছি। জীবন জীবিকা ও পরিবেশের সুরক্ষা হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়সহ প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ছাড়াও পরিবেশকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

কিন্তু দুঃখের বিষয় সময়ের সাথে সাথে শহরে-গ্রামে এখন জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ নিজেদের ইচ্ছেমতো জলাভূমিগুলো ভরাট করছেন। অথচ জলাভূমিগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়ের অভাব নেই, শুধু সংরক্ষণ করার অভাব! গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহর পর্যায়ে একের পর এক জলাভূমিগুলো ভরাট করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে প্রণীত জাতীয় পানি নীতির ৪.১৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “হাওর, বাঁওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। হাওর এবং বাঁওড়গুলোতে শুষ্ক মৌসুমেও যথেষ্ট গভীরতায় পানি থাকে তবে ছোট বিলগুলো সাধারণত চূড়ান্ত পর্যায়ে আর্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। এই বিলগুলো প্লাবনভুমির নিম্নতম অংশ। এই জলাশয়গুলো আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের সিংহভাগের উৎস এবং নানা ধরনের জলজ সবজি ও পাখির আবাসস্থল। তাছাড়াও শীত মৌসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে আগত অতিথি পাখিদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। হাওর এবং বিলগুলো খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। অতীতে প্রকৌশলগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক বিলকে তাৎক্ষণিক ফসল লাভের জন্য নিষ্কাশিত আবাদি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথমেই মাছ এবং গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের উৎস কচু, শাপলা, কলমি জাতীয় জলজ সবজির বিলুপ্তি ঘটে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবনভূমির বর্জ্য প্রবহমান খালের মাধ্যমে বাহিত ও শোধিত হয়ে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সেই প্রাকৃতিক শোধনক্রিয়া ব্যাহত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে।’

অন্যদিকে ২০০০ সালে প্রণীত ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, ‘...হাওর ও জলাভূমি এলাকা অর্থ নিচু প্লাবিত অঞ্চল যাহা সাধারণত হাওর এবং বাওর বলিয়া পরিচিত।’ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০-এর ১৮৭ নং অনুচ্ছেদে আছে, ‘বদ্ধ জলমহাল বলিতে এরূপ জলমহাল বুঝাইবে যাহার চতুঃসীমা নির্দিষ্ট অর্থাৎ স্থলবেষ্টিত এবং যাহাতে মৎস্যসমূহের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে মৎস্য ধরার উপযোগী। সাধারণত, হাওর, বিল, ঝিল, হ্রদ, দিঘি, পুকুর ও ডোবা ইত্যাদি নামে পরিচিত জলমহালকে বদ্ধ জলমহাল বলিয়া গণ্য করা হয়’। জাতীয় পানি নীতিতে আরও উল্লেখ আছে, ‘হাওর, বাঁওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যর ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ।

অথচ অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বিগত সরকার উন্নয়নের মহাসড়কে নামে গত এক দশকে নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বেশ কিছু বড় সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এর কোনো কোনোটি হাওরের পাশ দিয়ে, কোনোটি আবার হাওরের ঠিক মাঝ দিয়ে। যেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশের সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই না করেই ২০২০ সালে কিশোরগঞ্জে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ইটনা-মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম সড়ক চালু করে বিগত সরকার। ঘটা করে সরকারের আমলা, মন্ত্রীরা গিয়ে এসব সড়কের উদ্বোধনও করেছেন। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ এসব সড়ক নির্মাণের ক্ষতিকর দিক অনুধাবন না করে তখন উল্লসিত হলেও কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন শুরু থেকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় এই প্রকল্পগুলোর সমালোচনা করে আসছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই কর্তৃপক্ষ তখন তাদের কথায় কর্ণপাত করেনি। কিন্তু অবশেষে সরকার স্বীকার করেছে, এসব সড়ক নির্মাণ ঠিক হয়নি।

গত ২০ মে, ২০২৩ ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে গত সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী হাওরের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ যে ঠিক হয়নি তা স্বীকার করে বলেছেন, 'হাওরে যাঁরা বসবাস করেন, ভাল রাস্তা দিয়ে শহরে যাওয়ার জন্য তাঁদেরও অধিকার আছে। সরকারের আর্থিক অবস্থাও তখন ভালো ছিল। তখন আমরা হাওরে চমৎকার সড়ক নির্মাণ করেছি। কিন্তু এখন টের পাচ্ছি, ওই সড়ক বানিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে বেশি।' তিনি আরও বলেছেন, সড়কের কারণে পানির চলাচলের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। বর্ষার সময়ে পানি উপচে বাড়িঘরে উঠছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। হাওরের নিজস্ব প্রজাতির মাছ, গাছ—হিজল, কড়চ, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রাণী-বৃক্ষ ধ্বংস হচ্ছে। হাওরে সড়ক নির্মাণ-সংক্রান্ত আর কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। কারণ, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গল হয়েছে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী হাওরে বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ না করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং হাওরাঞ্চলে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি করা হলে, সেটি ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে বলেছেন।

সরকারের ‘প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০’ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা সম্পূর্ণ বেআইনি। আবার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বর্তমানে আইন অমান্য করে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছেন। এর ফলে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

শহরাঞ্চলে সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য জলাভূমির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জলাভূমিগুলো নগরের তাৎক্ষণিক পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস। ২০১০ সালে যখন ঢাকার ‘ড্যাপ’ (ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল, তখন ভাবা হয়েছিল ঢাকার চারপাশের জলাভূমিগুলো রক্ষা পাবে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমিদস্যুতা ও প্রভাবশালীদের চাপে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে এক সময় প্রায় ২ হাজার পুকুর, ৫২টি খাল ও অসংখ্য ঝিল ছিল। কিন্তু এর বেশিরভাগই এখন আবাসনের চাহিদা মেটাতে নিচু জায়গা ভরাট করতে গিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বছরে প্রায় ৫ হাজার একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে সারা দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪২ হাজার একর জলাধার ভরাট করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে জলাভূমি ভরাটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বেশিরভাগ খাল ও নিচু জায়গা ভরাট করে ফেলার ফলে এখন একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে।  

‘নদ-নদীর দেশ’ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ থেকে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া মানে জেনে-বুঝে দেশের ক্ষতি ডেকে আনা। জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে জলাভূমি নির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জলাভূমিগুলো আমাদের সম্পদ, জীববৈচিত্র্যের আধার ও প্রাণের স্পন্দন। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় জলাধারগুলো রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

আমার বার্তা/জেএইচ