বাংলাদেশের রাজধানী কি ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া উচিত?
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২৩ | অনলাইন সংস্করণ
সাদিয়া সুলতানা রিমি
![](/assets/news_photos/2025/02/10/image-42177-1739168819.jpg)
রাজধানী একটি দেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক নগরী, যা দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। তবে বর্তমান সময়ে ঢাকার ওপর প্রচণ্ড জনসংখ্যার চাপ, যানজট, পরিবেশ দূষণ এবং অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে অনেকেই রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন যে, রাজধানী পরিবর্তন করা ব্যয়বহুল ও কঠিন হবে। তাই এ বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
ধারণক্ষমতার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি মানুষের চাপে হাঁসফাঁস করছে রাজধানী ঢাকা। এই চাপ কমাতে কিছু একটা করতেই হবে। হোক তা রাজধানী স্থানান্তরের মাধ্যমে, কিংবা আমাদের প্রশাসনিক খাতগুলোকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিকেন্দ্রীকরণের সাহায্যে।
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ এখানে বসবাস করে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে। যদি রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে ঢাকার ওপর এই চাপে কিছুটা স্বস্তি আসবে।ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যানজট। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কর্মস্থলে যাওয়া-আসার সময় প্রচণ্ড যানজটে আটকে থাকে, ফলে অর্থনীতি ও উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি, গাড়ির কালো ধোঁয়া ও শিল্প কারখানার দূষণের ফলে বায়ুর গুণমান ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। নতুন পরিকল্পিত রাজধানী গড়ে তুললে এসব সমস্যা কমানো সম্ভব।
ঢাকা শহরের পুরনো ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো নতুন প্রযুক্তি ও নগর পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু নতুন একটি পরিকল্পিত রাজধানী তৈরি করা হলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, প্রশস্ত রাস্তা, উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ঢাকা একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা এবং নিচু জমিতে গড়ে ওঠায় এটি বন্যার ঝুঁকিতেও রয়েছে। ভবিষ্যতে বড় কোনো দুর্যোগ হলে রাজধানী হিসেবে ঢাকার অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই একটি নিরাপদ ও উঁচু স্থানে নতুন রাজধানী তৈরি করা হলে এটি দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে।
গত ১৮ জানুয়ারি, ২০২২ এ ইন্দোনেশিয়ার সংসদ ঘোষণা দেয়, তারা তাদের রাজধানীকে জাকার্তা থেকে বোর্নিও দ্বীপের একটি নতুন শহর নুসানতারায় সরিয়ে নিয়ে যাবে। জাকার্তা জাভা দ্বীপে অবস্থিত এবং শুধু এই শহরেই প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। জাভা দ্বীপে রাজধানী থাকায় এখানেই ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ বসবাস করে। দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অর্ধেকেরও বেশি জাভাতেই হয়। অথচ কালিমান্তান দ্বীপটির আয়তন জাভার তুলনায় চার গুণ।
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে দেশটির সংসদ বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছে। সেসব কারণের মধ্যে উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব, বন্যার ঝুঁকি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়া, অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টন ছাড়াও রয়েছে রাজধানী হিসেবে জাকার্তার দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা।
প্রায় একই সময়ে, মিশরের সরকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কায়রোর ৪৫ কিলোমিটার পূর্বে একটি নতুন রাজধানী গড়ে তোলার। দেশটির বর্তমান রাজধানী প্রায়ই তীব্র যানজটে নাকাল হয়ে পড়ে। এমন যানজটের নেপথ্যে রয়েছে রাজধানীতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনিক ভবনের অবস্থান।
জাকার্তা বা কায়রোর অবস্থার সঙ্গে খুব সহজেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার।
ঢাকাতেও ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে (যদিও অবস্থা জাকার্তার মতো অতটা খারাপ নয়)। এ শহরের বাতাসকে শ্বাস গ্রহণের অনুপযোগীই বলা চলে (একিউআইয়ের র্যাংকিয়ে নিয়মিত বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে থাকছে ঢাকা)। শহরের 'লাইফলাইন' হিসেবে বিবেচিত নদীগুলো এত বেশি দূষণের শিকার হয়েছে যে সেগুলোর অবস্থা পুনরুদ্ধারের আশাও এখন ম্লান হয়ে পড়েছে। আর সেই সঙ্গে এ শহরে রয়েছে অনন্ত, অবিরাম যানজট।
গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২১ বা বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা সূচক ২০২১-এ বাংলাদেশের ৪০০ বছর বয়সী রাজধানী ঢাকা ছিল সারা বিশ্বের মধ্যে বিদেশিদের আতিথেয়তা প্রদানের সক্ষমতায় নিচ থেকে ৪ নম্বরে। একই সঙ্গে জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে ঢাকা শহরের অবস্থান বিশ্বের মধ্যে ৬ষ্ঠ, যেখানে জাকার্তা বা কায়রো এমনকি শীর্ষ দশেও নেই।
এখন ঢাকা মহানগরীকে আর বিশেষ কোনো বিশেষণে পরিচিত করার উপায় নেই। রাজধানী ছাড়িয়ে শিল্পনগরী, বাণিজ্যনগরী বলাও যথার্থ হয় না। ১৭ কোটি মানুষের যেন একমাত্র কর্মসংস্থানের জায়গা ঢাকা। প্রচলিত সব পণ্যের পাইকারি বাজার, ছোট-বড় শিল্প, কলকারখানা, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। মানুষের জন্য শহরে ২৫% হারে রাস্তা, ১০% খোলা জায়গা, ১৫% বৃক্ষ থাকার কথা। সেখানে ৬% রাস্তা ছাড়া ঢাকায় খোলা জায়গা এবং বৃক্ষ নেই বললেই চলে।
ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ৮৫ শতাংশ স্থাপনা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্রাণহানির আশঙ্কা কমপক্ষে ৬০ শতাংশ। সবচেয়ে বড় কথা, এমনটি হলে ঢাকার রাস্তা পরিষ্কার করতে সময় লাগবে ৩ বছর, উদ্ধার কাজ শুরু করতে ব্যয় হবে ১২০ দিন সময়। এমনকি প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে যাবে, যে কারণে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। সুতরাং ড্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে তার বিশেল্গষণ করা আবশ্যক। ঢাকাকে বাসযোগ্য এবং আধুনিক নগরীতে পরিণত করতে হলে দেশের প্রশাসনিক রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত।
একটি রাজধানী হিসেবে ঢাকার উপর চাপের বোঝা ঠিক কতটা, সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খানের কাছে। তিনি বলেন, "একটি রাজধানীর যে পরিমাণ জনসংখ্যাকে আদর্শ ধরা যায়, ঢাকায় বাস করে তারচেয়ে তিন থেকে চারগুণ বেশি মানুষ। আবার অবকাঠামোগত দিক দিয়ে, একটি টেকসই রাজধানীর যে পরিমাণ অবকাঠামো থাকা প্রয়োজন, ঢাকার রয়েছে তার থেকে তিন-চার গুণ কম।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আমানত উল্লাহ খানও একই অভিমত ব্যক্ত করেন।
"আপনি যদি মস্কো, ওয়াশিংটন ডিসির মতো বিশ্বের আরো বেশি কার্যকর কিছু রাজধানীর দিকে চোখ ফেরান, দেখবেন সেগুলো সবই এমনভাবে পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল, যেন প্রয়োজনমাফিক তাদের সম্প্রসারণ সম্ভব হয়। ঢাকার বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়। আক্ষরিক অর্থেই এখানে সম্প্রসারণের বিন্দুমাত্র জায়গা অবশিষ্ট নেই। তাই এই শহর লোকের ভিড়ে গিজগিজ করে। যানজটের মাত্রা এতটাই বেশি যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ৩-৪ ঘণ্টাও সময় লেগে যায়," ড. আমানত উল্লাহ বলেন।
ঢাকার উপর এমন অতিনির্ভরতার সবচেয়ে সমস্যাজনক দিক হলো অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সর্বগ্রাসী রূপ। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এমন জনবহুল শহরে বিনিয়োগ করলেও সেখান থেকে লাভ আসে অতি নগণ্য। তাই এ ধরনের শহরের অবকাঠামোয় সরকার যতই মেট্রোরেল, সাবওয়ে বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যোগ করুক না কেন, বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া কোনোভাবেই এসব বিনিয়োগ আশানুরূপ ফল বয়ে আনবে না। অর্থনৈতিক লাভ বৃদ্ধি কিংবা দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সব ধরনের ফলাফলই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে।
তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে: ঢাকাকে দিয়ে যেহেতু এই রাষ্ট্রের কার্যক্রম ঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে কি আমাদের উচিত মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশের দেখানো পথ অনুসরণ করে দেশের রাজধানী ঢাকার বাইরে কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া?
কার্যত, ঠিক তা নয়।
কেননা অন্যান্য সমস্যা থাকলেও, একটি রাজধানী হিসেবে কৌশলগতভাবে ঢাকার অবস্থানই বাংলাদেশের সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গায়। রাজধানী শহরগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম, কেননা বৈদেশিক আক্রমণের সময় তারাই দেশের সরকারকে রক্ষা করে। ঢাকা দেশের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়া সে ব্যাপারটিকে আরো সুসংহতই করে। তাছাড়া রাজধানী শহরগুলো পালন করে একটি মিলনমেলা বা সন্ধিস্থলের ভূমিকাও, যেখানে দেশের সব অঞ্চলের মানুষই এসে ভিড় জমায়, সহজে চাকরির সন্ধান চালায়। তাছাড়া রাজধানী শহর ব্যবহৃত হয় সারাদেশ জুড়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং একতা সৃষ্টির কাজেও।
নতুন রাজধানী গড়ে তুলতে বিশাল অর্থ ব্যয় হবে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করতে কয়েক লাখ কোটি টাকা লাগতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।ঢাকায় ইতোমধ্যে সব সরকারি দপ্তর, মন্ত্রণালয় এবং বিদেশি দূতাবাস স্থাপিত রয়েছে। নতুন রাজধানীতে এগুলো স্থানান্তর করা সময়সাপেক্ষ ও কঠিন হবে। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীও ঢাকাকেন্দ্রিক, ফলে রাজধানী বদলালে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ঢাকা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এখানে রয়েছে মুঘল আমলের স্থাপত্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ নানা ঐতিহ্যবাহী স্থান। রাজধানী সরালে এসব ঐতিহ্যের গুরুত্ব কমে যেতে পারে।
এসব কারণেই সাধারণত পরামর্শ দেওয়া হয় যে একটি রাজধানী যেন ভৌগোলিকভাবে দেশের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত হয়। আর সে কথা মাথায় রাখলে, বাংলাদেশের বেলায় ঢাকার চেয়ে ভালো জায়গা আর হতেই পারে না।
আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, একেক দেশ একেক কারণে তাদের রাজধানী স্থানান্তর করে। তাই অন্ধের মতো তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ হবে বোকামি। ইন্দোনেশিয়া জাকার্তা থেকে তাদের রাজধানী শহর সরিয়ে নিচ্ছে প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়া এবং বন্যার উচ্চ ঝুঁকি থাকার ফলে। অন্যান্য নানা দেশও রাজনৈতিক কারণে তাদের রাজধানী পরিবর্তন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মিশরের কথা। তারা রাজধানী সরিয়ে নিচ্ছে, কারণ দেশটির বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসানো সেনাবাহিনী নতুন শহরের অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিভিন্ন সম্পদের বেচাকেনা থেকে লাভবান হতে পারবে। এদিকে সামরিক জান্তা শাসিত মিয়ানমারও তাদের প্রশাসনিক রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে নেপিদে সরিয়ে নিয়েছে; সাধারণ জনগণের থেকে সামরিক সরকারকে রক্ষার উদ্দেশ্যে।
তাছাড়া, রাজধানী শহরকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া ভীষণ ব্যয়বহুলও বটে। যেমন বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, নতুন একটি শহরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে ইন্দোনেশিয়ার খরচ হবে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার, আর মিশরের সম্ভাব্য খরচ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
সেদিক থেকে চিন্তা করলে, বাংলাদেশকেও তেমন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবিস্তারে লাভ-ক্ষতির বিচার-বিশ্লেষণ করে নিতে হবে।
যেমন ড. আদিল বলেন, "গোটা রাজধানী শহরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেক খরচসাপেক্ষ ব্যাপার। একটি নিম্ন-মধ্য আয়ের স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অপ্রয়োজনে এমন বিনিয়োগ করার সাধ্য নেই। আমাদের বরং মনোযোগ দেওয়া উচিত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের দিকে।"
এর অর্থ, আমাদের উচিত প্রশাসনিক খাতগুলোকে ক্রমান্বয়ে বিকেন্দ্রীকরণ করা। এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় বা প্রশাসনিক খাতকে এমন কোনো অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া উচিত, যে অঞ্চলের সঙ্গে সেগুলোর অবস্থান সঙ্গতিপূর্ণ।
যেমন ধরুন, কৃষিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনিক দপ্তরগুলোকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, যে অঞ্চলটি দেশের কৃষির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। শিল্প মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট ব্যুরোগুলোকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে চট্টগ্রামে, যেহেতু সবচেয়ে বেশি রপ্তানি-কেন্দ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় ওই অঞ্চলেই।
ড. আমানত উল্লাহ খান এ বিষয়ে একমত, এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশের উচিত আইনপ্রণয়নকারী শাখাগুলোকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, "সংসদ ভবনটি তৎকালীন আইয়ুব খানের সরকারের তরফ থেকে একটি সান্ত্বনা পুরষ্কার বৈ আর কিছুই নয়। আজ এটি নিছকই অতীতের একটি স্মৃতি। তাই, সরকারের আইনপ্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধীরে ধীরে শহরের বাইরে নিয়ে গেলে ভালো হয়।"
সরকারের প্রশাসনিক ও বিধানিক শাখাগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি, ঢাকার উপর থেকে চাপ কমানোর আরো বেশ কিছু উপায় আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর একাধিক রাজধানী রয়েছে। তাদের প্রশাসনিক রাজধানী প্রিটোরিয়ায়, বিচারিক রাজধানী ব্লুমফন্টেইনে, এবং আইনসভার রাজধানী কেপটাউনে।
ঢাকাকে প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ অতিরিক্ত আরো কিছু বাণিজ্যিক রাজধানীরও ঘোষণা দিতে পারে। এতে করে বর্তমান রাজধানী ঢাকার উপর চাপ কমবে, এবং নতুন রাজধানীতে ব্যবসা করার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
এদিকে, বাংলাদেশের অন্যান্য বড় শহরে না যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ী নেতারা প্রায়ই কারণ হিসেবে দেখান সেসব শহরে অবকাঠামোগত ঘাটতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহের অধারাবাহিকতা, প্রায়ই ভোল্টেজ হ্রাস পাওয়া ইত্যাদিকে। তাদের এসব অভিযোগ যুক্তিগ্রাহ্য, কেননা বাংলাদেশে বর্তমানে কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রামেই ব্যবসার অনুকূল উপযুক্ত অবকাঠামো রয়েছে।
পুরো রাজধানী শহরকেই সরিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য হতে পারে, তবে দেশের অন্যান্য বড় শহরে বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে খরচ অনেক কম হবে, আর তাতে রসদের চাহিদাও কম।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সরকারের সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সরকারি মেগা প্রজেক্টই ঢাকা বা চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক। এখন অবধি সরকারের তরফ থেকে কোনো লক্ষ্য-নির্ধারিত, সুচিন্তিত বিকেন্দ্রীকরণের প্রচেষ্টার দেখা মেলেনি।
৪০০ বছরের পুরনো এই শহর অনেক আগেই লাইফ-সাপোর্টে চলে গেছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়ের কল্যাণের যন্ত্রণার মাত্রা হয়তো কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু যেসব ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ এ শহরের জীবনীশক্তিকে একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে, সেসব চাপের লাঘব না ঘটাতে পারলে, এসব প্রকল্পের কোনোটিই আমাদের ভালোবাসার শহরকে একটি বিশৃঙ্খলাময় সর্বনাশের শহরে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে না। হুজুগের বশবর্তী না হয়ে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। না বুঝে বিরোধিতা করার চেয়ে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া মঙ্গলজনক। আমাদের প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশের রাজধানী ইতিমধ্যে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ভারতের নয়াদিলিল্গ, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, মালয়েশিয়ার পুত্রজায়া, মিয়ানমারের নেপিদহ, ব্রাজিলের ব্রাজিলিয়া ইত্যাদি স্থানান্তরিত রাজধানী। আধুনিক বিশ্বে রাজধানী কেবল প্রশাসনিক এবং আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। প্রশাসনকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে ক্রমাগত বিকেন্দ্রীকরণ করা ছাড়া উপায় নেই। দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল বা প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে সমগুরুত্ব দেওয়া আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাজধানীর অজুহাতে একটি মাত্র শহরকে জগাখিচুড়ি করে সৌন্দর্য, নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের পরিপন্থী করে রাখা সমীচীন নয়। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। আইন প্রণয়ন ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য সুস্থ পরিবেশ আবশ্যক। কাজেই রাজধানীর জন্য ভিন্ন মাত্রিক শহরই উপযুক্ত। এতসব যুক্তি-উপাত্ত এবং গবেষণা ছাড়াও সময় আর প্রগতি-প্রকৃতির নিরিখে বলা যায়, আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশের রাজধানী স্থানান্তর করার বিকল্প থাকবে না। স্বল্প আয়তনের ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের জন্য আগেভাগেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
সর্বোপরি রাজধানী সরানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। এটি ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ এবং প্রশাসনিকভাবে কঠিন একটি প্রক্রিয়া। তাই সরাসরি রাজধানী পরিবর্তনের বদলে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অন্যান্য শহরগুলোর উন্নয়ন করাই যৌক্তিক হতে পারে। ঢাকার ওপর চাপ কমিয়ে অন্য শহরগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা গেলে, রাজধানী সরানোর প্রয়োজন নাও হতে পারে।
সুতরাং, বাংলাদেশের রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার আগে সুপরিকল্পিতভাবে এ বিষয়ে গবেষণা ও কৌশল নির্ধারণ করা উচিত।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।
আমার বার্তা/জেএইচ/সাদিয়া সুলতানা রিমি