কক্সবাজারে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দূরীকরণ প্রয়োজন
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:১৪ | অনলাইন সংস্করণ
কমল চৌধুরী:

বঙ্গোপসাগর কন্যা কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ায় লবণ পানি শোধনাগার ও বড় বড় পানি রিজার্ভার না থাকায় খাবার পানি ও ব্যবহার উপযোগী পানির তীব্র সংকট রয়েছে। প্রায় সমস্ত কক্সবাজার জুড়েই গ্রীষ্মকালে এ পানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। পবিত্র মাহে রমজান মাসে ও এর ব্যতিক্রম হবে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়, বন ও বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেষে গড়ে ওঠা শহর, নগর কক্সবাজার। বাংলাদেশে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ কক্সবাজার ও বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতের কলাতলী, ইনানী ও হিমছড়ি বীচ এলাকা। বিশ্বমানের নানা আবাসিক হোটেল, গেস্ট হাউজ ও রেস্টুরেন্ট এর শহর কক্সবাজার। শুধু বাংলাদেশ নয়-বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশীরা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতের টানে বারবার ছুটে আসে কক্সবাজার। কারণ কক্সবাজারের মতো এতো দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। তাই বাংলাদেশ ও বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের প্রাণের শহর কক্সবাজার।
স্যামুয়েল টেইলর কলয়িজ তার বিখ্যাত The rise of the anciet Mariner একটি গল্পে তার বিখ্যাত উক্তি, “Water water everywhere, but there is no water for drinking..” (ওয়াটার ওয়াটার এভ্রিহোয়ার, বাট দেয়ার ইজ নো ওয়াটার ফর ড্রিংকিং) অর্থাৎ, পানি -পানি সর্বত্রই, কিন্তু খাবার পানি নেই। তেমনি কক্সবাজারের সর্বত্রই বঙ্গোপসাগরের বিপুল জলরাশি থাকলেও অত্যাধিক লবণাক্ততার জন্য বঙ্গোপসাগর ও তার পাশের নাফ নদী এবং অন্যান্য নদীর পানিতে তীব্র লবনাক্ততা থাকায় এ পানি খাবার এবং বসবাস সহ গৃহস্থলী কাজের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী, তবে এ লবণাক্ত পানি লবণ শোধনাগারে শোধন করলে তা সুপেয় হয়ে উঠে। তাই কক্সবাজার জেলায় লবনাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য লবণ পানি দূরীকরণ শোধনাগার(জঙ) নির্মাণ করা হলে পানির চাহিদা পূরণ হবে। এছাড়াও, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনে বড় রিজার্ভার খনন করে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রমে জরুরী সহায়তা প্রকল্পের আওতায়-এডিবির অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট স্থানে সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন বাস্তবায়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর টেকনাফ পৌরসভা, টেকনাফ উপজেলার ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, উখিয়া উপজেলার সকল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নানা সংকট মোকাবেলা করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং জনবলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ - উপজেলায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রম জরুরী সহায়তা প্রকল্পের সফল প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ গোলাম মোক্তাদিরের সুদক্ষ, বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট স্থানে সফল ভাবে সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে।
ইএপির প্রকল্প পরিচালক বলেন,কক্সবাজার জেলা বাংলাদেশ এর অন্যান্য জেলা থেকে সম্পূর্ন আলাদা, এখানে একদিকে রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অন্যদিকে প্রতিদিন আগত লক্ষাধিক পর্যটকের ভীড়। আরও রয়েছে তীব্র পানির সংকট। তাই, ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজার জেলায় পানি সরবারহ ব্যব্যস্থা চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহন ও উপযুক্ত পানির উৎস না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু বর্তমানে এডিবির সাহায্যপুষ্ট জরুরী সহায়তা প্রকল্পের আওতার বাকখালী নদীর পানি ওয়াটার ট্রিট্মেন্ট প্লান্ট এর সাহায্যে পরিশোধন করে পৌর এলাকায় পানি সরবরাহের বাস্তবায়নে কাজ চালু রেখেছেন। এছাড়াও এডিবির অর্থায়নে টেকনাফ উপজেলায় শালবাগানে ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জরুরী সহায়তা প্রকল্প(ইএপি) এর অধীনে সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মিত হয়। এই রিজার্ভারের মাধ্যমে ক্যাম্পে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
ইতিমধ্যে কক্সবাজার পৌরসভায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রম প্রায় সম্পন্ন করেছেন। টেকনাফ উপজেলার ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও উখিয়ার, সকল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সফলতার সাথে সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন কার্যক্রম অবিরামগতিতে চলমান রয়েছে। তবে, গ্রীষ্মকালে পানির চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কারণ গ্রীষ্মকালে টেকনাফ ও উখিয়ার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নীচে গেছে। ফলে ডিপটিউবওয়েলগুলোতে পানি কম আসে তাছাড়া ঐসকল স্থানে মাটির নীচে পাথর থাকায় নতুন করে ডিপটিউবওয়েল বসানো যাচ্ছে না। একটি ডিপটিউবওয়েল বসাতে ১৫/২০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
এডিবির অর্থায়নে ক্যাম্প নাম্বার ২৬ শালবাগান সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এ একটি পানির রিজার্ভার রয়েছে। প্রতিদিন এই রিজার্ভার থেকে সকালে ৩ ঘন্টা এবং বিকেলে ৩ ঘন্টা ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পানি সরবারহ করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন প্রায় ২ লক্ষ ঘন মিটার পানি এই ক্যাম্পে সরবারহ করা হয়। গত মাসে অর্থাৎ ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫২ লক্ষ ৭৫ হাজার বর্গমিটার পানি সরবরাহ করা হয়েছে। ২৬ নং ক্যাম্পে একটি সারফেস ওয়াটার পাম্প ও রয়েছে। ইএপি এর আওতায় ২২,২৪,২৫,২৬,২৭ ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এ দৈনিক পানির চাহিদা রয়েছে ১৭৩৫ ঘনমিটার এবং ২৬ নং এর জন্য ৫০০ ঘনমিটার। ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লোক সংখ্যা ৪২,৭৫০ জন এবং পরিবারের সংখ্যা ৮৯৯৪ টি। এডিবি সূত্র বলছে ইএপি থেকে ২২,২৪,২৫,২৬,২৭ ও নয়াপাড়া রিফিউজি ক্যাম্পে পানি সরবরাহ করা হয়। তবে, সম্প্রতি উক্ত ক্যাম্প সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এর জন্য পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ সংকট মোকাবেলায় প্রকল্প হতে ইতিমধ্যে ক্রয়কৃত ৭টি ওয়াটার ক্যারিয়ার দিয়ে ওয়াটার ট্রাকিং করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহন সাধু খাঁ বলেন, কক্সবাজার একটি পর্যটন এরিয়া হওয়ায় প্রতিনিয়ত পানির চাহিদা বেড়ে চলেছে। সুপেয় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউনিসেফ, জাইকা এর সহায়তায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বাস্তব চাহিদা মোতাবেক মাঠ পর্যায়ে অবিরাম কাজ করে চলেছে।
পালংখালি রিজার্ভার: প্রায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি এতে ধারণ করা হবে। পালংখালি থেকে একটি পাইপ লাইন উখিয়া কুতুপালং বাজার পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে পানি সরবরাহের জন্য। শুকনো মৌসুমে পানির চ্যালেঞ্জ থাকায় এবং ভূগর্ভস্থ পানি প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাওয়ায় ২৬ নং ক্যাম্পে ও পালংখালি রিজার্ভার থেকে পানি সরবরাহ করা হবে। পরবর্তী প্রকল্পে উক্ত রিজার্ভার হতে পালংখালী থেকে ২৬ নং ক্যাম্পের দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার এবং টেকনাফের দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার, এর ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হচ্ছে।
পালংখালী রিজার্ভার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও হোস্ট কমিউনিটিতে পানি সরবরাহ করা হবে। তাহলে টেকনাফ থেকে ১৩ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন করে ২৪,২৬,২৭ ও নোয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পানি সরবরাহ করা হবে। পালংখালী রিজার্ভার থেকে পালংখালী ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডে পানি পাবে। পালংখালী থেকে সমস্ত টেকনাফে পানি সরবরাহ করা হবে। ২৬ নং ক্যাম্পে এখন প্রতিদিন প্রতিজনকে প্রায় ১৪ লিটার করে পানি দেয়া হচ্ছে। পূর্বে প্রতিদিন প্রতিজনকে ২০ লিটার করে পানি দেয়া হতো। ২৬ নং ক্যাম্পে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে রিজার্ভার থেকে ইএপি লোক ছাড়া ও এনজিও ফোরাম, টিডিএস, ডিএসকে কাজ করছে। তারা তাদের নিজস্ব পানি সরবরাহ ছাড়া ও ইএপির রিজার্ভার থেকে ২৬ নং ক্যাম্পে পানি সরবরাহ করে থাকে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এডিবির অর্থায়নে ৪০টি মিনি পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম স্থাপন করা হয়েছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবারহকৃত পানি ট্যাপস্ট্যান্ড হতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের চাহিদা মাফিক প্রতিদিন গড়ে ২০লিটার করে পানি সংগ্রহ করে থাকেন। উখিয়া জালিয়া পালং ইউনিয়নে সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। উখিয়া রাজা পালং ও পালংসার ইউনিয়নের লবণাক্ত পানিতে আয়রনের মাত্রা ও বাড়ছে। উখিয়াতে পূর্বে ডিপটিউবওয়েল বসাতে ৬০-৭০ ফুট (পানির লেয়ারের ক্ষেত্রে) নিচে পাইপ দিলেও এখন ১৩০ ফুট নিচে চলে গেছে। কক্সবাজার জেলায় প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য পানি সরবরাহ প্রাপ্তি অনেকাংশে লাঘব হবে। এছাড়াও, দীর্ঘমেয়াদী সুপেয় পানি প্রাপ্তির জন্য জরুরী ভিত্তিতে আরও নতুন প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়ও দ্যা ডেইলি বেষ্ট নিউজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই