ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ দেশের দূর্বল আইন ব্যবস্থা

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৫, ১৭:২৭ | অনলাইন সংস্করণ

  সাদিয়া সুলতানা রিমি:

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা প্রতিবছর বেড়ে চলেছে। এসব ঘটনার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও একথা স্পষ্ট যে দুর্বল আইন ব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতি অপরাধীদের শাস্তি এড়ানোর সুযোগ প্রদান করে, যার ফলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

আইন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও অপরাধ প্রতিরোধে তার প্রভাব

১. বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘায়িততা ও জটিলতা : বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলাগুলোতে বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘায়িত। অপরাধী বিচার থেকে বাঁচার জন্য প্রায়ই মামলার সময়সীমা অনেক বেশি হয়ে যায়। দীর্ঘায়িত বিচার প্রক্রিয়া শুধু শিকারদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে না, অপরাধীদের আবারও নতুন অপরাধ করার সুযোগ করে দেয়। আদালতে মামলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত না হলে অপরাধীরা মনে করে যে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তি দেওয়ার সম্ভাবনা কম।

২. দুর্নীতি ও আইন প্রয়োগে অসঙ্গতি : আইনের প্রয়োগে দুর্নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। দুর্নীতিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা, তদন্তে অনিয়ম এবং পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনুপযুক্ত ব্যবস্থাপনা অপরাধীদের জন্য একটি সুরক্ষিত আশ্রয়স্থান সৃষ্টি করে। অপরাধীদের জন্য অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শাস্তি এড়ানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, যা অপরাধের হার বাড়ানোর কারণ হিসেবে কাজ করে।

৩. আইনগত ফাঁক-ফোকর ও দুর্বল বিধান : বর্তমান আইন ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে অপরাধের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ও কঠোর শাস্তির বিধান প্রদান করতে ব্যর্থ। ধর্ষণ মামলায় দোষীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান না থাকায় অপরাধীরা সহজেই অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। বিশেষ করে, বিবাহিত জীবনে ধর্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট আইনগত বিধান না থাকায় শিকাররা যথাযথ ন্যায়বিচার পেতে ব্যর্থ হন।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

১. লিঙ্গ বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ : বাংলাদেশে লিঙ্গ বৈষম্য একটি গভীর সামাজিক সমস্যা। নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে নারীকে সামাজিকভাবে দুর্বল এবং অধীনস্থ হিসেবে দেখা হয়, ধর্ষণ অপরাধকে উৎসাহিত করে। এই ধরনের সমাজে, নারীদের প্রতি সহিংসতা ও শোষণের ঘটনা স্বাভাবিক মনে করা হয়, যার ফলে শিকাররা মামলা করতে এগিয়ে আসে না এবং অপরাধীরা অপরাধ চালিয়ে যায়।

২. সামাজিক লজ্জা ও মামলার ভয় : ধর্ষণের শিকাররা সামাজিক লজ্জা, কলঙ্ক এবং ভয়ের কারণে মামলা দায়ের করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। সমাজে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং তাদের বিচার করা হয়ে থাকে। এই কারণে, শিকাররা প্রায়ই নীরব থাকে এবং অপরাধীরা বিচারহীনভাবে অপরাধ চালিয়ে যায়।

৩. যৌন শিক্ষার অভাব : বাংলাদেশে যৌন শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার অভাবও ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সঠিক যৌন শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষার অভাবে নতুন প্রজন্ম অপরাধের নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে, অপরাধের প্রতি অসচেতনতা বৃদ্ধি পায় যা অপরাধীদের অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে।

দুর্বল আইন ব্যবস্থার প্রভাব

১. অপরাধের পুনরাবৃত্তি : যখন বিচার ব্যবস্থা দুর্বল হয়, তখন অপরাধীরা শাস্তি এড়ানোর সুযোগ পায় এবং পুনরায় অপরাধ করে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে, যদি অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি না দেওয়া হয়, তবে তারা আবারও একই অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এতে করে সমাজে অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং ধর্ষণের হার আরও বাড়ে।

২. শিকারদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি : ধর্ষণের শিকাররা শুধু শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন না, বরং মানসিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী ট্রমা, বিষন্নতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং কখনও কখনও আত্মহত্যার প্রবণতার শিকার হন। আইন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও বিচারহীনতার কারণে শিকাররা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ব্যর্থ হন, যা তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে।

৩. সমাজে নিরাপত্তাহীনতা ও অবিশ্বাস : দুর্বল আইন ব্যবস্থা এবং বিচার প্রক্রিয়ার কারণে সমাজে অবিশ্বাস ও নিরাপত্তাহীনতার ভাবনা সৃষ্ট হয়। যখন সাধারণ মানুষ দেখতে পায় যে অপরাধীরা সহজেই বিচারের আওতায় আসে না, তখন তারা নিজেরাও নিরাপত্তাহীন বোধ করে এবং সমাজে সামগ্রিকভাবে আইন ও শৃঙ্খলার প্রতি আস্থা হারায়।

>> সম্ভব সমাধান ও সুপারিশ

১. আইন সংস্কার ও কঠোর শাস্তির বিধান

আইন সংস্কার: ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা মোকাবিলায় আইন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। সুনির্দিষ্ট আইনগত বিধান প্রণয়ন করা প্রয়োজন যা ধর্ষণের শিকারদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান প্রদান করে।

কঠোর শাস্তি: অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রদান করে আইন ব্যবস্থার শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা জরুরি। বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুততা এবং সঠিকতার দিকে নজর দিতে হবে যাতে অপরাধীরা বিচার থেকে বাঁচতে না পারে।

২. দুর্নীতি রোধ ও আইন প্রয়োগে স্বচ্ছতা

দুর্নীতির অবসান: পুলিশ ও বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি কমানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠন করা যেতে পারে।

প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি: আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, পুলিশ, এবং বিচারকেদের মধ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে তারা সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারে।

৩. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধি

সামাজিক প্রচারণা: সমাজে লিঙ্গ সমতা, নারীদের অধিকার ও সম্মানের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মিডিয়া, এনজিও ও সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রচারণা চালানো যেতে পারে।

যৌন শিক্ষা: স্কুল, কলেজ এবং সমাজে যৌন শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক প্রবর্তন অপরিহার্য। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে সঠিক সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতন করা যাবে, যা ভবিষ্যতে ধর্ষণের ঘটনা কমাতে সাহায্য করবে।

৪. শিকারদের সহায়তা ও পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা

আইনি সহায়তা: ধর্ষণের শিকারদের জন্য বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান করা উচিত যাতে তারা মামলা দায়ের এবং ন্যায়বিচার পেতে সক্ষম হন।

মানসিক ও শারীরিক পুনরুদ্ধার: শিকারদের মানসিক ও শারীরিক পুনরুদ্ধারের জন্য কাউন্সেলিং, থেরাপি ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে, শিশু, নারী ও মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন।

৫. সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব

সরকারি উদ্যোগ: সরকারের উচিত ধর্ষণের বিরুদ্ধে কার্যকরী আইন প্রয়োগ ও বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে উদ্যোগী হওয়া। নতুন আইন প্রণয়ন ও বর্তমান আইনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আইনানুগ সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা জরুরি।

বেসরকারি ও সিভিল সোসাইটি: বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। মানবাধিকার সংস্থা, নারী সংগঠন ও এনজিওগুলোকে আরও শক্তিশালী করে শিকারদের জন্য সেবা প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করা উচিত। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক সংস্থা ও Donor ফান্ডের সহযোগিতায় দেশের আইন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ করা যেতে পারে, যা বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

প্রভাব ও ফলাফল

১. সামাজিক পরিবর্তন : কঠোর আইন ব্যবস্থা ও দুর্নীতির অবসান, যৌন শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতার ফলে সমাজে লিঙ্গ সমতা এবং নারীদের প্রতি সম্মান বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে, ধর্ষণের ঘটনা হ্রাস পাবে এবং শিকারদের জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

২. অপরাধ প্রতিরোধ : দুর্বল আইন ব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়া যদি শক্তিশালী করা যায়, তাহলে অপরাধীরা শাস্তি এড়াতে পারবে না। এর ফলে, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা কমে আসবে এবং অপরাধ প্রতিরোধে সমাজে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ করা যাবে।

৩. শিকারদের পুনরুদ্ধার : শিকারদের মানসিক ও শারীরিক সহায়তার মাধ্যমে তাদের পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা যাবে। আইনগত সহায়তা ও মানসিক থেরাপির ব্যবস্থা শিকারদের সমাজে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত হতে সহায়তা করবে এবং তাদের জীবনে নতুন আশার প্রদর্শন করবে।

বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্বল আইন ব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতি। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘায়িততা, দুর্নীতি, আইনগত ফাঁক-ফোকর, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট একত্রে অপরাধীদের শাস্তি এড়ানোর সুযোগ করে দেয়। এর ফলে, অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং শিকাররা ন্যায়বিচারের আশায় ব্যর্থ হন।

সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ, যার মধ্যে আইন সংস্কার, দুর্নীতি রোধ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, যৌন শিক্ষা প্রসার এবং শিকারদের জন্য যথাযথ সহায়তা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনাকে একটি জাতীয় সংকটে পরিণত হতে দেখা যাচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় আইন ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দূর করে, কঠোর শাস্তির বিধান প্রণয়ন ও কার্যকর প্রয়োগ, এবং সমাজে লিঙ্গ সমতা ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য।

এবার সময় এসেছে, আমাদের সকলের উচিত এই অপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো, আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক সমাজ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। যদি আমরা এই ধরণের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি, তবে ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে এবং শিকাররা ন্যায়বিচার পেতে সক্ষম হবে।

দেশের দুর্বল আইন ব্যবস্থা শুধু অপরাধীদের জন্য আশ্রয়স্থল সৃষ্টি করে না, বরং সমাজের সামগ্রিক নিরাপত্তা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। এজন্য, আইন সংস্কার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি, সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিকারদের সহায়তা প্রদান অপরিহার্য।

সর্বোপরি, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আইন ব্যবস্থা, সমাজের সার্বিক সমর্থন এবং নাগরিকদের সচেতনতা মিলে একটি নিরাপদ সমাজ গঠনের মূল চাবিকাঠি। দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিত এই লক্ষ্য অর্জনে অবিচলভাবে কাজ করা, যাতে একটি ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।


লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আমার বার্তা/সাদিয়া সুলতানা রিমি/এমই