প্রকৌশল পেশায় প্রহসনের ছক: বঞ্চনার বৃত্তে বন্দি প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ার
প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪২ | অনলাইন সংস্করণ
প্রজ্ঞা দাস:

বর্তমানের বিশ্বে যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হলো সেই দেশের ইঞ্জিনিয়াররা। কিন্তু বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টর আজ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। যেখানে দেশের প্রকৌশলীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন, সেখানে নিজ দেশেই তাদের যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। ইঞ্জিনিয়াররা দেশের সর্বোচ্চ মেধার প্রতিনিধিত্ব করে। ভর্তি পরীক্ষার কঠিন প্রতিযোগিতা, চার-পাঁচ বছরের ঘাম-ঝরানো পরিশ্রম, অগণিত রাত নির্ঘুম অধ্যায়ন,সব কিছু পেরিয়ে তারা এক সময় প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠেন। কিন্তু চাকরির বাজারে প্রবেশ করে তারা এক অন্যায় এবং অনেয্য বাস্তবতার মুখোমুখি হন। সরকারি চাকুরিতে পদোন্নতি, বেতন কাঠামো এবং চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের অধিক সুবিধা দেওয়া হয়। এমনকি, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে ডিপ্লোমাধারীরা কোটার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রেখেছেন। ফলে বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারীরা চাকরির বাজারে অবহেলিত হচ্ছেন।বাংলাদেশে প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য এই বাস্তবতা কেবল অবজ্ঞার নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের লজ্জার বিষয়। একটি জাতি যখন তার শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তানদের অবমূল্যায়ন করে, তাদের পরিশ্রম ও মেধাকে অপদস্থ করে, তখন সেটি কেবল ব্যক্তিগত হতাশা তৈরি করে না, বরং রাষ্ট্রের অর্থনীতি, পরিকাঠামো, পরিকল্পনা ও নিরাপত্তার ভিত দুর্বল করে।
ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েটদের জন্য দেশে সরকারি চাকরির সুযোগ সীমিত। যেসব পদ তাদের জন্য নির্ধারিত, সেসব পদে ঢুকতে বিসিএস নামক পরীক্ষায় বসতে হয়, যেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতার চেয়ে মুখস্থবিদ্যার জয়জয়কার। তারপরও যখন কেউ বিসিএসে ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডারে আসে, তখন রাষ্ট্র তাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে প্রকৌশল দক্ষতাকে খাটো করে। সড়ক বিভাগের প্রকৌশলী কাগজে-কলমে সাইন করে সময় কাটায়, কাজের গঠনমূলক দায়িত্ব হয় তার বাইরে। একদিকে তা মেধা অপচয় , অন্যদিকে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেও সেই জ্ঞান দেশের কাজে লাগাতে না পারা এক চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনা। তার চেয়েও ভয়ংকর বাস্তবতা হলো, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং পদগুলোতে ডিপ্লোমা হোল্ডাররা প্রমোশনের মাধ্যমে জায়গা দখল করে থাকেন।সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে প্রায় ১০০% জায়গা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের দখলে, যেখানে প্রকৃত বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রবেশাধিকার প্রায় অনুপস্থিত। এই বৈষম্যমূলক বাস্তবতা তৈরি করেছে চরম এক অসাম্য ও হতাশা। অথচ এই ডিপ্লোমাধারীরাই পরে কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খন্ডকালীন বা পরিপূর্ণভাবে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে আবার আবেদন করছেন একই পদের জন্য, যা প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ এক অদ্ভুত জোড়াতালি দিয়ে চলছে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টর।বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন উচ্চতর গবেষণার জন্য। আবার কেউ সরাসরি গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন বা ইউরোপীয় নির্মাণ কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। তারা আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতা করছেন, জিতছেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অথচ এই মেধাবীরা দেশের মাটিতে চরম অবহেলার শিকার। তাদের কাছে দেশে ফিরে কাজ করার কোনো বাস্তব প্রণোদনা নেই, নেই সম্মান, নেই পর্যাপ্ত সুযোগ কিংবা পর্যাপ্ত জব সেক্টর। এর বিপরীতে দেশ নিজের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি কোম্পানি বা কনসালট্যান্ট নিয়ে আসে। আমদানি করা হয় জাপানিজ , চাইনিজ বা ইউরোপীয় টেকনিক্যাল টিম। শুধু কারণ দেশের প্রকৃত ইঞ্জিনিয়াররা সুযোগ পান না। অথচ যারা চেয়ারে বসে থাকেন তারা এসকল মেগা প্রজেক্টের জন্য অযোগ্য। বাংলাদেশের যে কোন মেগা প্রজেক্ট করতে বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার কিংবা টেকনিক্যাল টিমের উপর যে ব্যয় হয় তা অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।যে রাষ্ট্র প্রতিভাকে খাটো করে, ডিপ্লোমার যুক্তিকে প্রকৌশল বিজ্ঞানের ওপর স্থান দেয়, সে রাষ্ট্র কাঠামোগত দুর্বলতাকে নিজের নীতি বানায়। একজন প্রকৃত বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, যিনি চার বছর ধরে উচ্চতর গণিত, পদার্থ, মেকানিক্স, থার্মোডাইনামিক্স, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, এবং সফট স্কিল শিখে তৈরি হয়েছেন, তাকে বসতে হচ্ছে এমন দপ্তরে যেখানে টেন্ডার তৈরির ফাইল ঘাঁটাই প্রধান কাজ। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তাদের মতামত গুরুত্ব পায় না, আর পদের যোগ্যতায় তার চেয়ে কম শিক্ষিত কেউ বসে থাকে সিনিয়র হয়ে কেবল অভিজ্ঞতার অজুহাতে। অভিজ্ঞতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তা কখনোই শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না।
এই অব্যবস্থার ফলে দেশ উন্নতির পথে এগোচ্ছে না, বরং ভুল নীতির চোরাবালিতে আটকে যাচ্ছে। তাই পদ্মা সেতু করতে হয় বিদেশিদের দিয়ে, মেট্রোরেল চলে বিদেশিদের তত্ত্বাবধানে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট হয় রাশিয়ান ইনস্টলেশনে।ইঞ্জিনিয়ারদের এই মেধাহীন ব্যবস্থায় আটকে রেখে শুধু ব্যক্তির নয়, পুরো দেশের ভবিষ্যৎকে জিম্মি রাখা হয়েছে। আজ যেসকল ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা আন্দোলন করছে তারা যদি যোগ্য হন, তাহলে সকল কোটা উঠিয়ে দিয়ে সমান সুযোগ নিশ্চিত করে পরীক্ষা , মেধা এবং যোগ্যতার যাচাইয়ের মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরগুলোতে পদায়ন এবং পদোন্নতির ব্যবস্থা করা উচিত। বাংলাদেশের প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ারদের এই অবহেলা বন্ধ না হলে রাষ্ট্র ভবিষ্যতে মুখ থুবড়ে পরবে। তাই বিসিএসে আলাদা "প্রকৌশল ক্যাডার" চালু করা এবং মেগা প্রজেক্টগুলোতে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের পরিবর্তে বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের অগ্রাধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশিদের আনতে হলে শুধুমাত্র উচ্চতর টেকনিক্যাল পরামর্শকের ভূমিকায় রাখা যেতে পারে।একটি জাতি তখনই উন্নত হয়, যখন সে তার মেধাকে রপ্তানি নয়, রক্ষা করে এবং দেশের মেধাবী ছাত্ররা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে, অবকাঠামো গঠনে, শিল্পায়নে ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে নেতৃত্ব দেয়। আজ বাংলাদেশের প্রকৃত ইঞ্জিনিয়াররা সেই সম্ভাবনা, যাদের সামনে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে অসংগঠিত প্রশাসনিক মানসিকতা, অবিচারপূর্ণ কোটানীতির চক্র এবং ডিপ্লোমা ভিত্তিক আধিপত্যের ছায়া। এই দেয়াল ভাঙতে পারলে শুধু বিদেশ নির্ভরতা নয় , আমাদের দেশেই হবে পরামর্শদাতা, নির্মাতা, উদ্ভাবক। তাই প্রয়োজন সাহসী রাষ্ট্রীয় পুনর্বিন্যাসের। যেখানে পলিসি হবে প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক এবং নেতৃত্বে থাকবে প্রকৃত ইঞ্জিনিয়াররা। তবেই বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে এবং বহির্বিশ্বের কাছে হবে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।
আমার বার্তা/জেএইচ