মৎস্য রপ্তানি বাণিজ্যে ই-ট্রেসিবিলিটি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন দিগন্ত

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৩০ | অনলাইন সংস্করণ

  সাকিফ শামীম:

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের জিডিপিতে এই খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য, এবং এটি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস। বর্তমানে দেশের মৎস্য রপ্তানি প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তবে বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকতে হলে এবং রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়াতে হলে আমাদের পুরোনো পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা জরুরি। আর এখানেই ই-ট্রেসিবিলিটি (E-Traceability)-র গুরুত্ব অপরিসীম।

সহজভাবে বলতে গেলে, ই-ট্রেসিবিলিটি হলো এমন একটি পদ্ধতি যা একটি পণ্যের উৎপত্তির স্থান থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপকে ডিজিটালভাবে অনুসরণ ও রেকর্ড করে। মাছের ক্ষেত্রে ই-ট্রেসিবিলিটির মাধ্যমে মাছের পোনা সংগ্রহ, খামারে পরিচর্যা, খাদ্য সরবরাহ, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আহরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং এবং পরিবহন সম্পন্ন করা হয়। প্রতিটি ধাপে প্রয়োজনীয় তথ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করা হয়, যা একটি বারকোড বা কিউআর কোডের মাধ্যমে সহজে যাচাই করা যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য নিরাপত্তা এবং পণ্যের গুণগত মান নিয়ে ক্রেতারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে মৎস্য আমদানির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মকানুন রয়েছে। প্রায়শই আমদানিকারকরা পণ্যের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়। যদি কোনো পণ্যে সমস্যা ধরা পড়ে, তাহলে ই-ট্রেসিবিলিটির মাধ্যমে দ্রুত তার উৎস খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে মাছের পোনা, খাদ্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, এবং পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ই-ট্রেসিবিলিটি একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।

সাগর থেকে সংগ্রহ করা মাছের ব্যবসা, যা সামুদ্রিক মৎস্য খাত নামে পরিচিত, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। দেশের বিশাল উপকূলরেখা এবং বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলসীমা সামুদ্রিক মাছের বিশাল ভাণ্ডার সরবরাহ করে। এই খাতটি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই সাহায্য করে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের টুনা, রূপচাঁদা, লইট্টা এবং চিংড়ি। বিশ্ববাজারে এই মাছগুলোর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সামুদ্রিক মৎস্য খাতে ই-ট্রেসিবিলিটি ব্যবহার করলে মাছ ধরার স্থান, ট্রলারের নাম, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পরিবহনের প্রতিটি তথ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা পণ্যের উৎস এবং গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন, যা আমাদের রপ্তানি বাজারকে আরও সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।

ই-ট্রেসিবিলিটি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ বহুমুখী সুবিধা পাবে। উন্নত দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে আমাদের রপ্তানি বাজার আরও বাড়বে। এতে করে আমাদের মৎস্য খাতের রপ্তানি আয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। যখন আন্তর্জাতিক ক্রেতারা জানতে পারবেন যে বাংলাদেশের মৎস্যজাত পণ্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে উৎপাদিত হচ্ছে এবং এর প্রতিটি ধাপ স্বচ্ছ, তখন আমাদের পণ্যের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়বে। এটি "মেইড ইন বাংলাদেশ" ব্র্যান্ডের সুনাম বৃদ্ধি করবে।
এই ব্যবস্থা খামারিদের তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ করে তুলতে সাহায্য করবে। কোন পদ্ধতিতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে, কোন খাবার বেশি কার্যকর, এবং রোগবালাই প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা সফল—এইসব তথ্য ডিজিটালভাবে বিশ্লেষণ করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। ই-ট্রেসিবিলিটি ব্যবস্থা পণ্যের নকল বা জালিয়াতি রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এটি সম্পূর্ণ সাপ্লাই চেইনে স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে। এই ব্যবস্থা ক্ষুদ্র খামারিদের আন্তর্জাতিক বাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেবে। তারা তাদের পণ্যের গুণগত মান ডিজিটালভাবে প্রমাণ করতে পারবে, যা তাদের মধ্যস্বত্বভোগীদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেবে।

ই-ট্রেসিবিলিটি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেমন প্রাথমিক বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অভাব, এবং খামারিদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP) মডেল একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। এফবিসিসিআই-এর মতো শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন এবং সরকারি সংস্থা, যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একত্রে কাজ করলে এই পথচলা অনেক সহজ হবে। প্রথম ধাপে একটি পাইলট প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে, যেখানে কিছু নির্বাচিত খামার ও প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রকে এই ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। এর পাশাপাশি, মৎস্য খামারিদের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। সহজ এবং ব্যবহারবান্ধব সফটওয়্যার ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতে হবে, যাতে সবাই সহজেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে।
সবশেষে, আমি বিশ্বাস করি যে ই-ট্রেসিবিলিটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের মৎস্য খাতের ভবিষ্যৎ। এটি আমাদের রপ্তানি বাড়াবে, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন গতি আনবে।

লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।

আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই