আদর্শের সংঘাতে জোট রাজনীতি: এনসিপিতে নারীদের বিদ্রোহ
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩৪ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

তাসনিম জারা, তাজনূভা জাবীন ও মনিরা শারমিন (ওপরে বাঁ থেকে) এবং সামান্থা শারমিন, নুসরাত তাবাসুম ও নাহিদা সারোয়ার নিভা (নিচে বাঁ থেকে)জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি থাকায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারার পর এবার দল ছেড়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। তাসনিম জারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তাজনূভা নির্বাচন করবেন না বলে জানিয়েছেন।
আবার দল ছাড়ার ঘোষণা না দিলেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন। এ ছাড়া নির্বাচনকালে দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম। আর জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিন। এই তরুণ নারীরা জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা মুখ। জামায়াত নিয়ে তাদের এই অবস্থান জুলাইয়ের তরুণদের নেতৃত্বে গড়া নতুন দল এনসিপির জন্য বড় ধাক্কা। আগামী ফেব্রুয়ারির ভোট দলটির জন্য প্রথম জাতীয় নির্বাচন।
এনসিপি সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বাসায় বৈঠকে অংশ নেন ছয় নেত্রী। তারা হলেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন, নুসরাত তাবাসুম, তাজনূভা জাবীন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও নাহিদা সারোয়ার নিভা। বৈঠকে তারা প্রায় চূড়ান্ত হওয়া জামায়াত-এনসিপি আসন সমঝোতা নিয়ে আপত্তি জানান।
বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিপির শীর্ষ কয়েকজন নেত্রী জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিষয়ে সরাসরি বিরোধিতা করেন। বৈঠকে তারা জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে একযোগে পদত্যাগের হুমকি দেন। তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করা অথবা এককভাবে নির্বাচনের জন্য চাপ দেন।
গত শনিবার জামায়াতের সঙ্গে জোটে আপত্তি জানিয়ে নাহিদ ইসলামকে চিঠি দেন এনসিপির ৩০ নেতা। এর মধ্যে কয়েকজন নারীও রয়েছেন। চিঠিতে নেতারা তাদের আপত্তির ভিত্তি হিসেবে এনসিপির ঘোষিত আদর্শ, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা এবং গণতান্ত্রিক নৈতিকতার কথা তুলে ধরেন। অভিযোগ করা হয়, জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এনসিপির নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চরিত্র হননের চেষ্টা করে আসছে। পাশাপাশি চিঠিতে বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা, গণহত্যায় সহযোগিতা এবং সে সময় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ প্রশ্নে তাদের অবস্থান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও আমাদের দলের মূল্যবোধের সঙ্গে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক।’
এনসিপির কয়েকজন নেতা জানান, নারীদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে ভবিষ্যতে নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও কঠিন হয়ে যাবে। এরই মধ্যে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের সঙ্গে তাদের আসন সমঝোতার বিষয়টি জানান নাহিদ ইসলাম।
রাজনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীদের বিষয়ে জামায়াতের দলগত অবস্থান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এনসিপির নারী নেত্রীদের বর্তমান অবস্থান জামায়াতকে আবার প্রশ্নের মুখে ফেলল।
পদত্যাগ করে ভোটে তাসনিম জারা
গত শনিবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এনসিপি থেকে পদত্যাগের কথা জানান তাসনিম জারা। এর আগে সন্ধ্যা ৭টার দিকে দলটির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তথ্যটি জানান তিনি। তবে কী কারণে তিনি পদত্যাগ করছেন, সে বিষয়ে কিছু বলেননি। এ বিষয়ে সমকাল জানতে চাইলেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এনসিপি সূত্র জানায়, জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করায় অসন্তুষ্ট হয়ে তাসনিম জারা পদত্যাগ করেছেন। তিনি ঢাকা-৯ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। এই লক্ষ্যে গতকাল তিনি তাঁর পক্ষে ওই আসনের ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন।
তাজনূভা জাবীনের পদত্যাগ
গতকাল সকালে দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলেও জানান। তাঁর ঢাকা-১৭ আসন থেকে এনসিপির হয়ে নির্বাচন করার কথা ছিল। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন তাজনূভা। সেখানে বলেছেন, এনসিপিকে বিদায় জানালেও রাজনীতি ছাড়বেন না তিনি।
সরে গেলেন মনিরা শারমিন
দল থেকে পদত্যাগ না করলেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন। রোববার সন্ধ্যায় ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ ঘোষণা দেন। মনিরা শারমিন সমকালকে বলেন, একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা বলার পর এ ধরনের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার মতো নয়। এটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। তিনি বলেন, ‘আমি দলের সঙ্গে এখনও আছি, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত আপাতত নেই।’
নিষ্ক্রিয় থাকার ঘোষণা নুসরাত তাবাসসুমের
নির্বাচনের সময় দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম। গতকাল রাত ১০টার দিকে ফেসবুক পেজে তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। নুসরাত কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে এনসিপি থেকে প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে দলীয় মনোনয়ন কিনেছিলেন। তাঁর বাড়ি দৌলতপুর উপজেলায়।
ফেসবুকে নুসরাত লিখেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীসহ ১০-দলীয় জোটে শর্তসাপেক্ষে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমি মনে করি এনসিপির সর্বোচ্চ নেতা এবং নীতিনির্ধারকরা দলের মূল বক্তব্য থেকে চ্যুত হয়েছেন। এ অবস্থায় তৃণমূল পর্যন্ত বিশেষ করে মনোনয়ন নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে এই জোট ঘোষণার মাধ্যমে প্রবঞ্চনা করা হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রাথমিকভাবে নির্বাচন সময়ে পার্টির সব কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় করছি। অবস্থা পুনর্বিবেচনাক্রমে যে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘোষণা করছি।’
ঘোরতর আপত্তি সামান্থার
জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি থাকলেও দল থেকে পদত্যাগ করেননি সামান্থা শারমিন। জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থান, দর্শনসহ কোনো সহযোগিতা বা সমঝোতায় যাওয়া এনসিপিকে কঠিন মূল্য চুকাতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
এনসিপির সঙ্গে জোটের বিষয়ে জামায়াতের সংবাদ সম্মেলন-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সামান্থা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর প্রেস কনফারেন্স থেকে জানতে পারলাম এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটের আত্মপ্রকাশের দিন জোটের মুখপাত্র ও এনসিপির আহ্বায়কের বক্তব্য অনুযায়ী তা হওয়ার কথা নয়।’
সামান্থা বলেন, ‘তৃতীয় শক্তি তৈরির উদ্যোগকে ব্যাহত করে এমন অবস্থান জাতীয় নাগরিক পার্টির মূলধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমি এনসিপির এতদিনের সব বক্তব্যকে ধারণ করি। জাতীয় নাগরিক পার্টির কিছু মানুষ কিছু আসনের বিনিময়ে ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ বিকেল ৫.৩০-এ দলের মূল আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুত হলো।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমি এনসিপির আনুষ্ঠানিক সব বয়ান সাবস্ক্রাইব করি, তাই আমি পদত্যাগ করার কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না।’
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এম আলী রেজা সমকালকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে এনসিপির গঠন প্রক্রিয়ায় নারী নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাদের এভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া নবীন দলটির জন্য বড় হোঁচট।
দুই নেত্রী সঙ্গে থাকবেন– আশা নাহিদ ইসলামের
জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়টি জানাতে গতকাল রাতে বাংলামটরে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ সময় এনসিপি থেকে নারীদের পদত্যাগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ দলে থাকবে কিনা বা নির্বাচন করবে কিনা, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে দুই নারীনেত্রীর পদত্যাগ ও কয়েকজন নেতার আপত্তি দলে ভাঙন আনছে কিনা, সেই প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, তারা দলের নির্বাহী পরিষদে আলোচনা করে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘যারা বিরোধিতা করছে, তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলব। তাদের আরও বোঝানোর চেষ্টা করব। আশা করি, তারা এনসিপির এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে থাকবেন।’
এনসিপি থেকে পদত্যাগ করে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন, সেই সব আসনে এনসিপি প্রার্থী দেবে কিনা– এমন প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কে স্বতন্ত্র করছে, সেই অনুযায়ী এনসিপি প্রার্থী ঠিক করবে না। এনসিপির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে যারা ঐকমত্য, যারা মাঠে কাজ করেছেন, প্রার্থী হিসেবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তারাই প্রার্থী হবেন।’
