বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ১৪:১৮ | অনলাইন সংস্করণ

  শাহীন আলম:

* রয়েছে সশস্ত্র-সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষু আর এইডস-ইবোলার ঝুঁকি
* হাইতি থেকে পূর্বতিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সকল সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের রয়েছে পদচিহ্ন

শান্তিরক্ষা মিশনে (পিস কিপিং অপারেশন) অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে বাংলাদেশের কৃতিত্ব ও অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্রবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেমন দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে, তেমনি বিদেশে পেশাদারিত্ব ও নিবেদিত প্রাণ মনোভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে বিদেশিদের মন জয় করেছে। বাংলাদেশের সৈন্যরা দুর্গত মানবতার সেবায় যেমন কাজ করেছেন, তেমনি বিশ্বে শান্তি বিনষ্টকারী আগ্রাসী বাহিনীর মোকাবিলাও করেছেন। এক সংগ্রামী জাতির বাহিনী হিসেবে সবসময় তারা মানবতার ক্ষেত্রে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পরিবর্তিত বিশ্বের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিচক্ষণতা, পেশাদারিত্ব এবং বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বদা সহায়তা করা যাচ্ছে। যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে একটি সুন্দর ও বসবাস-উপযোগী সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলার শান্তিসেনারা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত (২০২৪) ৪৩টি দেশে/অবস্থানে জাতিসংঘের ৬৩টি শান্তি মিশনে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার ১৮৪ জন। বর্তমানে মোট ৬ টি দেশে সর্বমোট ৬টি মিশনে ৪ হাজার ৭০ জন সেনা সদস্য নিয়োজিত আছেন। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশসহ মোট শান্তিরক্ষীর সংখ্যা বর্তমানে ৬ হাজার ৯২ জন। বর্তমানে যে দেশগুলোতে শান্তিমিশন চলছে, সে দেশগুলো হলো- সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মালি, সাউথ সুদান, লেবানন, ডিআর কঙ্গো, ওয়েস্টার্ন সাহারা, লেবানন ও আবেই (সুদান)।

সশস্ত্র-সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষু আর এইডস-ইবোলার ঝুঁকি সঙ্গী করে পথ চলেছে বাংলার শান্তিরক্ষীরা। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশও দেশের জনগণের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্নত রাখতে নিরলস পরিশ্রম এবং ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন তারা। জাতি সংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই গৌরবের। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন সাহস, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, আত্মত্যাগের ব্রত নিয়ে সেখানে যুক্ত হয়েছে মানবিকতা।

এদিকে হাইতি থেকে পূর্বতিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সকল সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পদচিহ্ন রয়েছে। লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে আফ্রিকার গহীন বন থেকে শুরু করে উত্তপ্ত মরুভূমিতে। সংঘাতময় সমুদ্র এলাকায়ও উড়ছে বাংলাদেশের শান্তির পতাকা। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহ গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক আদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়। নীল হেলমেট মাথায় নিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের প্রায় সবখানে। শান্তিরক্ষীদের পেশাগত দক্ষতা, অঙ্গীকার, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিক কারণে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে আজ তারা দৃষ্টান্ত স্বরূপ।

জাতিসংঘ স্বীকৃত শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রথম পদযাত্রা শুরু। ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক  শান্তি মিশনে যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন চৌকস অফিসার প্রথম জাতিসংঘের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হয়। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া শান্তি মিশনের  মাধ্যমে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী বসনিয়ার শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে।

বর্তমানে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীর সদস্য সংখ্যা বিশ্বে ২য় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় সকল প্রান্তের দুর্গত নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এই শান্তি সেনাদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্ত মানবতার সেবা করে চলেছেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৩১ জন বীর সন্তান নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং ২৩৯ জন সদস্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তাদের এই ত্যাগ বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। আমাদের শান্তিসেনাদের এই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা বিশ্ব শান্তিরক্ষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

গত ৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশের শান্তি রক্ষীদের পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতার কারণে বিশ্বের মানুষের কাছে আজ তারা দৃষ্টান্তস্বরূপ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ সেনা প্রদায়ক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই শান্তিরক্ষিবাহিনীর সদস্যরা অসামান্য সাফল্যের ইতিহাস তৈরি করেছেন। কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোস্লোভাকিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো, আইভরিকোস্ট, সিয়েরালিওন, দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া, মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এর জটিল ও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বাংলার সাহসী শান্তিসেনারা পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে সেসব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।

শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশের নারী সদস্যগণের কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের ৩ হাজার ৩৮ জন নারী শান্তিরক্ষী শান্তিমিশনে অংশগ্রহণ করেছে। ২০০০ সালে পূর্ব তিমুরের শান্তি মিশনে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ পুলিশের একদল নারী শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। হাইতিতে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মহিলা পুলিশ কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করে ২০১০ সালে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নারী সদস্যগণ জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছেন। বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর ৩৭৩ জন ও বাংলাদেশ পুলিশের ১২০ জন নারী সদস্য মিশন এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন। 

 

আমার বার্তা/এমই