মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রি ভিসা নামের প্রতারণা

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:৩৩ | অনলাইন সংস্করণ

  মিনহাজ বিন মাহবুব:

দেশে কর্মসংস্থানের সংকট এবং একটি উন্নত জীবনের আশায় প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে লাখ লাখ বাংলাদেশি। ধর্মীয় মিল এবং স্বজনদের আধিক্যের কারণে এখন প্রবাস ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে আছে মধ্যপ্রাচ্য। গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত  ও নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষদের সরলতার সুযোগ নেওয়ার জন্য ফ্রি ভিসা নামের ভিসার উদ্ভব করেছে দালালরা। বস্তুত,  ফ্রি ভিসা নামের কোনো ভিসার অস্তিত্ব নাই। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের ভিসা প্রক্রিয়া এক এবং প্রত্যেকটি দেশে একই প্রক্রিয়াতে কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এসব দেশগুলোতে ফ্যামিলি ভিসা, ভিজিট ভিসা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং ভিসা, খাদ্দামা (বাসার কাজে মহিলা) ভিসা, তাব্বাক  (বাসার কাজে পুরুষ) ভিসা, ড্রাইভিং ভিসা, কোম্পানির ভিসাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভিসা দিয়ে থাকে।

কথিত ফ্রি ভিসা ইস্যু প্রক্রিয়া : মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কাজের চুক্তিতে ভিসা ইস্যু হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে স্থানীয় বাংলাদেশি দালালদের প্ররোচনায়  নিয়োগ কর্তা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের তুলনার অধিক ভিসা ইস্যু করেন। পরবর্তীতে দালালদের সাথে একটি মৌখিক চুক্তিতে নিয়োগ কর্তা তাদের হাতে ভিসা তুলে দেন। তারপর দালালরা গ্রামীণ জনপদের দরিদ্র মানুষের কাছে নানা রকম  আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে।

কথিত ফ্রি ভিসার কারণে সৃষ্ট সমস্যা: এসব ভিসা নিয়ে বিদেশ যাওয়া প্রবাসীর কাজের দায়িত্ব নিয়োগ কর্তা নেন না, নিজের কাজ  নিজের সন্ধান করতে হয়। কাজের জন্য সকাল-সন্ধা ঘুরতে হয় রাস্তায়। বাংলাদেশি শ্রমিকরা অধিকাংশ অদক্ষ হয়ে থাকেন এবং সাথে ভাষাগত সমস্যা থাকে নতুনদের, তাই তাদের জন্য একটি কাজ জোগাড় করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। কাজের ক্ষেত্রেও থাকে সীমাবদ্ধতা, সব কাজে কথিত ফ্রি ভিসার শ্রমিকদের নিয়োগ দেন না প্রতিষ্ঠান গুলো। বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে কোন রকমে একটি জোগাড় করতে পারলেও থাকতে হয় ভয়ের মধ্যে।  যেহেতু নির্দিষ্ট কোম্পানি ছাড়া বাইরে কাজের অনুমতি নেই, তাই  কাজ করা অবস্থাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও গুনতে হবে বিশাল অঙ্কের জরিমানা এবং জরিমানা প্রদানে অপারগ হলে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এছাড়াও কথিত ফ্রি ভিসায় কাজ করতে হলে কফিলকে ( নিয়োগ কর্তা)  কফালত (প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা) দিতে হয়,  অনেক সময় কাজ না থাকার কারণে কফিলকে কফালত দিতে অপরাগ হয়ে যায় প্রবাসীরা, এক্ষেত্রে আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) শেষে আকামা নবায়ন করতে বড় ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েন প্রবাসীরা। বিশেষত এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি অবৈধ প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

কথিত ফ্রি ভিসা প্রতি বাংলাদেশিদের আগ্রহের কারণ: প্রথমত, দালালদের নানা রকম আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখানো এবং  ভিসা প্রত্যাশীকে নানা রকম অবাস্তব নিয়ম কানুন বলা। দ্বিতীয়ত, প্রবাসে  থাকা অনেক আত্মীয় স্বজনরা তাদের দেশে থাকা স্বজনদের  যে কোনো মূল্যে প্রবাসে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা।
ধার-দেনা করে, জমিজমা বন্ধক রেখে, উচ্চ সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এমনকি অনেকেই নিজের সর্বস্ব বিক্রি করেও প্রবাসী  হচ্ছেন। প্রবাসে আসার পর যখন দেখেন, কাজের ব্যবস্থা করা যাচ্ছেনা কোন একটা কাজ জোগাড় করতে পারলেও বেতন একটা ভালো হয় না এতে অনেকেই চরম অর্থ কষ্টে ভুগেন, এমনকি অনেকের থাকার জায়গাটুকু কপালে জুটে না। কফালত,পরিবারের খরচ,ঋণের সুদ, আকামা নবায়ন সহ নানা রকম মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন এসব প্রবাসীরা, ফলস্বরূপ দেখা দেয় নানা রকম শারীরিক সমস্যা।  সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে প্রবাসী মৃত্যুর একটা বড় অংশ  হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করছে। পরিবারের সুখের আশায় প্রবাসী হলেও কফিনে বন্ধী হয়ে ফিরে যাচ্ছেন দেশে, ফলে প্রবাসীর পরিবারে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। সম্প্রতি এক ওমান প্রবাসী (ফ্রি ভিসায় কাজ করা) দীর্ঘদিন কাজ না থাকার কারণে অনেকদিন যাবত চরম অর্থ কষ্টে  জীবন অতিবাহিত করছিলেন, ভোগান্তির শেষ সীমান্তে আত্মহত্যা করেন। 

সকলের উচিত ভিসা নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক হওয়া এবং ফ্রি ভিসা নামের কোন ভিসা না  নেওয়া।  দালালের কাছ থেকে ভিসা না নিয়ে সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে ভিসা নেওয়া। দেশে কোন একটা কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে সরকার অনুমোদিত রিক্রুট এজেন্সির মাধ্যমে প্রবাসী হলে কাজের ক্ষেত্রে যেমন সুবিধা পাওয়া যায় তেমনি আর্থিকভাবে ও লাভবান হওয়া যায়।


লেখক : প্রবাসী, দোহা, কাতার
 

আমার বার্তা/এমই