কূটনৈতিক সংকট

বিদেশে যেমন দেখছি রাষ্ট্রদূতদের দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতি

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:১৬ | অনলাইন সংস্করণ

  রহমান মৃধা:

বাংলাদেশ বর্তমানে গভীর কূটনৈতিক সংকট এবং দুর্নীতির চক্রে বন্দী। রাষ্ট্রদূতদের দায়িত্বহীনতা, সরকারের দুর্বল কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং অর্থপাচারের মতো গুরুতর সমস্যাগুলোর ফলে দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্বলতা, অর্থপাচার রোধে ব্যর্থতা, এবং দুর্নীতির অবাধ বিস্তার প্রমাণ করে যে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কার্যকর হচ্ছে না। এই মতামতটিতে দুর্নীতি ও কূটনৈতিক দুর্বলতার প্রভাব, রাষ্ট্রদূতদের গাফিলতি এবং সম্ভাব্য প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি।

কূটনৈতিক দুর্বলতার কারণ ও প্রভাব

১. প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি:

বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যর্থ হচ্ছে, বিশেষ করে ভারতের ক্ষেত্রে।

শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ: কূটনৈতিক দুর্বলতার উদাহরণ

বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা, যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, দুর্নীতি, অর্থপাচার, খুন, এবং অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারত সরকার এসব বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও তাকে আশ্রয় দিয়েছে, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। ভারতের এ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা এবং দুর্বলতা নির্দেশ করে। প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে একজন অভিযুক্ত অপরাধীকে প্রতিবেশী দেশ আশ্রয় দিতে পারে এবং এটি আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মান কীভাবে প্রভাবিত করে? দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনিরা এভাবে পালিয়ে গেলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা টিকে থাকবে কি?

একটানা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একটি স্বৈরশাসক সরকার ক্ষমতায় আছে এবং দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট। বিচার প্রক্রিয়ায় কিছুটা অগ্রগতি হলেও, তা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী ভূমিকা রাখছে?

২. অর্থপাচার: আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে। রাষ্ট্রদূতদের অর্থপাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল, কিন্তু বাস্তবে তারা এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন, যা দেশের অর্থনীতির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

৩. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ

কূটনৈতিক দুর্বলতার ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার অবস্থান ক্রমাগত হারাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং দেশের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

রাষ্ট্রদূতদের দায়িত্ব পালনে ঘাটতি: একটি গুরুতর সমস্যা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। অধিকাংশ রাষ্ট্রদূতই দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে দেশের স্বার্থ উপেক্ষা করছেন। তাদের দায়িত্ব হলো বৈদেশিক মিশনের মাধ্যমে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা, এবং দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবে, তারা অনেক ক্ষেত্রেই এই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ।

১) প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা প্রদানে গাফিলতি: প্রবাসী বাংলাদেশিদের সুরক্ষা ও তাদের আইনি সহায়তা প্রদানে দূতাবাসগুলোর ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তারা প্রবাসীদের সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান করতে পারছে না এবং প্রবাসীরা হতাশায় ভুগছেন।

২) রাজনৈতিক নিয়োগের প্রভাব: বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে হওয়ায় তাদের দায়িত্ব পালনে পক্ষপাতমূলক আচরণ দেখা যায়। এর ফলে, দেশের স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে দলের প্রচার ও স্বার্থ রক্ষায় বেশি মনোযোগী হচ্ছেন তারা।

৩) দুর্নীতি ও অপচয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের অভাব: রাষ্ট্রদূতরা অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে ব্যস্ত থাকেন এবং দূতাবাসের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। বিদেশে অবস্থানকালে তারা অনেক ধরনের সুবিধা ভোগ করেন, কিন্তু কার্যত দেশের জন্য কাজ করছেন না।

পাসপোর্ট ইস্যু: একটি মৌলিক দায়িত্ব

পাসপোর্ট ইস্যু রাষ্ট্রদূতদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলির একটি। এ বিষয়টির যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি প্রবাসীদের জন্য মৌলিক সুবিধা প্রদান করে। পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি বা বিলম্ব হলে তা প্রবাসীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং দেশের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি জানে না দূতাবাসের দায়িত্বের গাফিলতির কথা? তা যদি না জানে, তবে দয়া করে তদন্ত করুন এবং যে কাজের জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা যেন তারা সঠিকভাবে পালন করে সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে নির্দেশ দিন। একটি দুর্নীতিমুক্ত এবং সুশাসিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রদূতরা তাদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে দেশপ্রেমিক ও পেশাদার হবেন। একই সাথে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে এ বিষয়ে, জনগণের অধিকার থেকে সেটা জানার চেষ্টা অপরাধ কি না? তা যদি না হয়, তবে তদন্ত করুন এবং জাতির কাছে জবাবদিহি করুন।

প্রস্তাবিত সমাধান ও সরকারের ভূমিকা

বাংলাদেশ সরকারকে রাষ্ট্রদূতদের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো হলো:

১. স্বচ্ছ ও দক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া: রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং আন্তরিকতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

২. অর্থপাচার বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা: রাষ্ট্রদূতদের অর্থপাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

৩. কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালীকরণ: মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আরও সক্রিয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কথা গুরুত্বের সঙ্গে শোনা হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান: জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করুন। এটি নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. স্বচ্ছ ও দক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া: রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা, পেশাদারিত্ব, এবং আন্তরিকতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

২. অর্থপাচার বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা: দেশের বাইরে থাকা রাষ্ট্রদূতদের অর্থপাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৩. কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালীকরণ: ভারতের মতো মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে, যাতে আমাদের কথা আন্তর্জাতিক মহলে শোনা হয়।

৪. বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও অনেক দূতাবাস রয়েছে। কতগুলো দূতাবাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশজুড়ে আছে এবং তাদের কাজ কী, জনগণ সেটা সঠিকভাবে জানতে চায়। জানতে চায় দেশের কী পরিমাণ অর্থ এদের পেছনে প্রতিবছর খরচ হয় এবং তাদের কাজ কী।

মেহনতি মানুষের জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতার বিনিময়ে রাষ্ট্রদূত হয়ে আজ বাংলাদেশের দায়িত্ব নেবার সুযোগ হয়েছে এটা মনে রেখে কাজ করতে হবে। দেশকে সোনার বাংলা করতে হলে শুধু রিকশাওয়ালা, দূরপরবাসী, জেলে, মুচি, মেথর, কুলি এবং কৃষকদের শোষণ আর শাসন করলে হবে না; সবাইকে সক্রিয়ভাবে মন প্রাণ দিয়ে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল এবং এই দুর্বলতা দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কূটনৈতিক দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রদূতদের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি রাখা, তাদের দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, এবং দেশের স্বার্থের সঙ্গে আপস না করার মনোভাব নিয়ে কাজ করা জরুরি। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানিত স্থান ফিরে পাবে বলে আমি মনে করি।


লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

আমার বার্তা/এমই