সাহাবিরা কীভাবে মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের শোক সামলে উঠেছিলেন?

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৫৩ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের দিনটি পুরো উম্মাহর জন্য ছিল শোক ও এক গভীর পরীক্ষা দিন। আকস্মিক শোকে অনেকের হৃদয় ভারাক্রান্ত হলেও কোরআনের শিক্ষা ও নবীজির দীর্ঘদিনের সানিধ্যের কারণে সাহাবিরা প্রস্তুত ছিলেন প্রিয় নবীর মৃত্যুর বাস্তবতা মেনে নেওয়ার জন্য। তারা সেই শোককে পরিণত করেছিলেন প্রজ্ঞা, দায়িত্ববোধ এবং ঐক্যে।

কোরআনের মাধ্যমে পূর্বপ্রস্তুতি

আলেমরা বলেন, আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াতগুলোর মাধ্যমে সাহাবিদের আগে থেকেই প্রস্তুত করছিলেন। উহুদের যুদ্ধের সময় নবীজি নিহত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়া সেই শিক্ষার অংশ ছিল। কোরআনে বর্ণিত হয়েছিল, নবী হোক বা অন্য যে কোনো রসুল, তাদের মৃত্যুর পরও দ্বীন অটুট থাকে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন,

‘…মুহাম্মদ তো একজন রাসুল মাত্র; তার আগে অনেক রাসুল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন, তবে কি তোমরা পেছনে ফিরে যাবে…’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৪৪)

মুফাসসির ইমাম রাজি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, যেমন পূর্ববর্তী রাসুলরা ইন্তেকাল করেছেন, নবী মুহাম্মদও তেমনই ইন্তেকাল করবেন। কিন্তু তাদের অনুসারীরা যেমন দ্বীন ধরে রেখেছিলেন, মুসলমানদেরও তেমন স্থির থাকতে হবে।

‘মৃত্যু যে নিশ্চিত’—এই বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে কোরআন

কোরআন আরও একাধিক আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে—নবীও মানুষ, তাকেও মৃত্যুবরণ করতে হবে। বর্ণিত হয়েছে, নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যু বরণ করবে এবং তারাও মৃত্যু বরণ করবে। (সুরা যুমার, আয়াত : ৩০)

ইবনে আশুর বলেন, এ আয়াত সাহাবিদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে নবীজির সময় সীমিত। জীবিত থাকতে যতটুকু পাওয়া যায়, তা গ্রহণ করতে হবে। যেন তার মৃত্যুর পর কেউ বিভ্রান্ত না হয়।

একইভাবে আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমার আগে কোনো মানুষকেই আমি চিরস্থায়ী করিনি ‘(সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩৪)

ইমাম রাজি মন্তব্য করেন, যেহেতু তিনি শেষ নবী, কেউ ভুলভাবে ভাবতে পারে তিনি অমর; তাই আয়াতটিতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে তিনি অন্য নবীদের মতোই মৃত্যুবরণ করবেন।

আল্লাহ তায়ালা দ্বীন সম্পূর্ণ করেছেন, তাই নবীজির পরে শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি

সুরা মায়েদার বিখ্যাত আয়াতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছি…’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৩)

সাহাবিরা এই আয়াতকে নবীজির বিদায়ের বার্তা হিসেবে বুঝেছিলেন। কারণ, এর পর আর কোনো নতুন বিধান নাজিল হয়নি। ফলে নবীজির ইন্তেকালের পরও মুসলিম সমাজ কোনো দিশেহারা অবস্থায় পড়েনি। হালাল-হারাম স্পষ্ট ছিল, এবং যে সামান্য অমীমাংসিত বিষয় ছিল, তা কোরআনের মূলনীতির আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল।

কোরআনের শিক্ষাকে ধারণ করে সাহাবিদের দৃঢ় অবস্থান

নবীর ইন্তেকালের দিনটি উম্মাহর ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়। কিন্তু সাহাবিরা ভেঙে পড়েননি; কারণ তাদের সামনে ছিল কোরআন, ছিল নবীর রেখে যাওয়া স্পষ্ট চেতনা। তারা বুঝেছিলেন, দ্বীন ব্যক্তিনির্ভর নয়, নীতিনির্ভর।

তাই সিদ্ধান্তে নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা অবলম্বন করেছিলেন শূরা, পরামর্শ ও ঐক্য। আবু বকর, ওমর, আলী, আয়েশা (রা.)—তারা সবাই উম্মাহকে এক সুতায় গেঁথে রাখার দায়িত্ব নেন। বিদ্রোহী গোত্রগুলোকে সামলে রাখেন, ইসলামের ঐক্য রক্ষা করেন এবং মানুষকে ফিরিয়ে আনেন সুন্নাহর সঠিক পথে।

নবীজির ইন্তেকাল যদিও সবার মাঝে শোক বয়ে এনেছিল, কিন্তু তা উম্মাহর মনোবোল ভেঙে দিতে পারেনি। কারণ– 

  •     কোরআন আগে থেকেই সাহাবিদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল।
  •     দ্বীন ছিল সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ।
  •     নবীর শিক্ষা ছিল স্পষ্ট, বাস্তবভিত্তিক।
  •     সাহাবিরা গভীর ঈমান ও ঐক্যের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন।

এই প্রস্তুতির কারণেই তারা অল্প সময়ের মধ্যেই সেই ভয়াবহ শোক কাটিয়ে উঠে উম্মাহকে স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয়। তারা প্রমাণ করেছিলেন যে তারা সত্যিই ‘মানবজাতির জন্য উদ্ভাসিত উত্তম উম্মাহ।’ - সূত্র : আল জাজিরা


আমার বার্তা/এমই