পুরান ঢাকার ১৮টি স্পটে ওসি ফান্ডের নামে দিনে কোটি টাকার চাঁদাবাজি

ওসি বললেন, থানায় এ নামে কোনো ফান্ড নেই, সব অপপ্রচার

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৪, ১০:৩৮ | অনলাইন সংস্করণ

  মাসুদ রানা

রাজধানীর পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানার অন্তর্ভুক্ত ১৭টি স্পট বা এলাকা এখন সন্ত্রাসী আর চাঁদাবাজদের স্বর্গরাজ্য। রাস্তা আর ফুটপাতে দোকান বসিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করছে একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডকেটের নেপথ্যে রয়েছে খোদ কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি অসৎ চক্র আর সরকারদলীয় পরিচয়দানকারী স্থানীয় কিছু অসাধু নেতা। দৈনিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে এই সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে হয়। থানার হয়ে চাঁদা আদায় করে পুলিশের লাইনম্যানরা। আর চাঁদা আদায়কারীদের ভাষায় এটা হচ্ছে ‘ওসি ফান্ড’এর টাকা। 

এই অভিযোগের ব্যাপারে গতকাল কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান আমার বার্তাকে বলেন, তার থানায় ওসি ফান্ড বলে কোনো ফান্ড নেই। তার বা তার থানার  বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ পুরোটাই মিথ্যা, বানোয়াট এবং একটি মহলের অপপ্রচার। বরং তারা চাঁদাবাজি বন্ধে এবং চাঁদাবাজদের ধরতে প্রতিদিনই তারা তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

তবে থানারই একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ঢাকার ধোলাইখাল, বংশাল, নবাবপুর রোড, বাংলাবাজার, চক মোগলটুলী রোড, নয়াবাজার, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, নলগোলা, আরমানিটোলা, ইসলামপুর রোড, জনসন রোড, তাঁতীবাজার, কোতোয়ালি রোড, বাদামতলী রোড, ওয়াইজঘাট, শ্যামবাজার ছাড়াও সদরঘাট এলাকার আশপাশের রাস্তা ও ফুটপাতে পোশাক ও ফলের দোকান বসিয়ে হকারপ্রতি দৈনিক নিয়মিত যে চাঁদা তোলা হয়, সেটা জমা হয় এই ওসি ফান্ডে। তাছাড়া বিভিন্ন পরিবহন থেকেও পুলিশের নামে আদায় হয় চাঁদা। স্পট আর ব্যবসার ধরন অনুযায়ী দৈনিক ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। প্রতিদিন এই চাঁদার টাকার অংক দেড় কোটি ছাড়িয়ে যায়। সবচাইতে বেশি চাঁদা আদায় হয় তাঁতীবাজার, মিটফোর্ড ওষুধ আর কেমিক্যাল মার্কেট, ইসলামপুরের কাপড় পট্টি আর ধোলাইখাল এলাকা থেকে।
সূত্র আরও জানায়, পুলিশ ফান্ডে যে টাকা আসে তার পুরোটাই থানা পুলিশ পায় না। এই টাকার একটা অংশ লাইনম্যান সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলের কয়েকজন কর্মকর্তা, স্থানীয় কয়েকজন ওয়ার্ড কমিশনার ও জনপ্রতিনিধি, কয়েকজন ছাত্র নেতাসহ বেশ কয়েকটি ফান্ডে এই টাকা ভাগ হয়ে যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদরঘাট টার্মিনালের পূর্ব দিকে শ্যামবাজারের কোনা থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত দুই পাশ মিলিয়ে ফলমুল শাক-সবজি, পোশাক, জুতা, লুঙ্গিসহ ৫ শতাধিক দোকান আছে।  প্রতি দোকান থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে দৈনিক দেড় থেকে দুই লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় এখান থেকে। অন্যদিকে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে বাটা সিগনাল পর্যন্ত রাস্তার ওপর দুই শতাধিক অবৈধ দোকান বসানো হয়েছে। এখান থেকে সব মিলিয়ে প্রতিদিন দুই লাখ টাকার উপরে চাঁদা তুলছে পুলিশ আর স্থানীয় চাঁদাবাজরা।

ওয়াইজঘাট এলাকা চাঁদাবাজদের একটি পছন্দের কেন্দ্র। শ্মশানঘাট ও মসজিদ গেটের নুতন ভবনের সামনে ফুটপাতের দেড় শতাধিক দোকান থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা নেয় পুলিশ। পুরান কাপড়, মোবাইল ও জুতার দোকান থেকে আদায় হয় প্রতিদিন ৩৫০ টাকা। এই টাকা আদায় করেন কোতোয়ালি থানা পুলিশের লাইনম্যান মোতাহার ও নুরু। ফুটপাথ ছাড়াও রাস্তার অর্ধেক দখল করে বসেছে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনীর দোকান।  চাঁদা আদায় হয় এখান থেকেও।

চাঁদাবাজদের জন্য মগের মুলুক হচ্ছে বাদামতলী ও ইসলামপুর  এ এলাকার বিভিন্ন রোডে প্রায় হাজার খানেক ফুটপাত দোকানি রয়েছেন। দোকানপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় পুলিশকে । এসব দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন পুলিশের লাইনম্যান ইউনুস, পেট পোড়া সাইফুল ও সালাম। ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা থেকে চাঁদা আদায় করে লাইনম্যান মনির, গোপাল ও বাবুল

বংশালের ফ্রান্স রোডে প্রতিদিনই বসে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ, মাংস, শাক-সবজিসহ প্রায় তিন শতাধিক দোকান বসে রাস্তায়। সকাল ৯টা পর্যন্ত বিক্রি করে হকাররা। এসব হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ টাকা করে চাঁদা তোলেন পুলিশ সোর্স হাসান।

পাশের নয়াবাজার পুরনো লোহার মার্কেট ও বাবুবাজার আকমল খান সড়ক থেকে পুলিশের নামে প্রতিদিন তিন লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়।

কেরানীগঞ্জের ব্যাবসায়ী আরমান আলী ও আবু আজাদ আমার বার্তাকে জানান, এলাকায় প্রবাদ আছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পা ফেলতেই দিতে হয় চাঁদা। এখানে ওসি ফান্ড বলে একটা তহবিল আছে। সেই ফান্ডে টাকা না দিলে কেউই ব্যবসা করতে পারবে না। তা সে যতবড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন। আসলে অসৎ পুলিশের চাইতে বড় মাস্তান আর কেউ হতে পারে না। নৌকা বা ট্রলারে উঠতে চাঁদা, নামতেও চাঁদা। মাঝ নদীতেও চলে নানা নামে নানা ধরনের চাঁদাবাজি। ঘাটে ঘাটে এমন চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী পুরান ঢাকা আর কেরানীগঞ্জের বাসিন্দারা।

তারা আরও জানান, কোতোয়ালি থানার চাঁদাবাজি নতুন কিছু নয়। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কয়েক মাস আগে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে আব্দুর রহিম নামে এক ব্যবসায়ী আদালতে মামলা পর্যন্ত করেন। মামলায় পুলিশের এক সোর্সসহ আরও অজ্ঞাতনামা তিন জনকে আসামি করা হয়েছে।

আসলে ডিএমপি পুলিশের কাছেও এই থানাটা হচ্ছে স্বর্ণের খনি। শোনা যায়, এই থানাতে একজন ওসিকে বদলি হয়ে আসতেও নাকি কয়েক কোটি টাকা লাগে।

এলাকাবাসীর অভিযোগের মুখে গত ৬ মে র‌্যাব বাবুবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে চাঁদা আদায়কালে হাতেনাতে রাজু, সুমন ও রিপন নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এরা তিন জনই ছিলো কোতোয়ালি থানা পুলিশের সোর্স ও এলাকার চিহ্নিত চাঁদাবাজ।