আনার হত্যাকান্ড: সবকিছুই যেন অদৃশ্য

প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৪, ১১:১৬ | অনলাইন সংস্করণ

  শাহীন আলম

সংসদ সদস্য আনার হত্যার ঘটনায় রিমান্ডে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে চরমপন্থি নেতা শিমুল ভুইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুইয়া ওরফে আমানউল্লাহ সাঈদ, তানভীর ভুইয়া ওরফে ফয়সাল ও শিলাস্তি রহমানকে। তিনজনই ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। তাদের দেয়া তথ্যে বেরিয়ে আসছে অনেকের নাম। তবে কোনোটিরই নির্ভরযোগ্যতা নেই। সকালের দেয়া তথ্যের সাথে বিকেলে মিল পাচ্ছে না গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাই তাদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বিভিন্ন দিকদিয়ে। তবে তদন্তে কয়েকটি নামসহ অনেক কিছু বেরিয়ে এলেও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এখনি কিছুই বলছেন না। গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোনো কিছুই বলতে চাচ্ছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

 

এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে আগেও দুবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ। জাতীয় নির্বাচনের আগে একবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন তারা ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় বারও ব্যর্থ হন আক্তারুজ্জামান শাহীন ও আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। সেবার চলতি বছরের ১৭ থেকে ১৮ জানুয়ারি আনোয়ারুল কলাকাতায় যান। সেই সময়ে হত্যাকারীরাও তাকে খুনের উদ্দেশে কলকাতায় যান। কিন্তু আনার হোটেলে থাকার কারণে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তৃতীয় ধাপে তারা এসে সফল হন। গতকাল শনিবার রাজধানীতে ডিবির কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এদিকে হত্যার ঘটনা তদন্তে আজ কালের মধ্যেই ভারত যাবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল। অরদিকে ভারতীয় পুলিশের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, আনারকে হত্যা ও তার মরদেহ টুকরো টুকরো করার পর সেটির পাশে বসেই খাবার ও মদ খায় হত্যাকারীরা।

এদিকে অনেক বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছে গোয়েন্দা টিম। এমপি আনারের সাথে কার কার সম্পর্ক ছিল। কার কার সাথে বিরোধ ছিল সব কিছুই আমলে নেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালে এমপি আনারের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দীলিপ আগারওয়াল। তবে তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ হলে ২০১৬ সালে সব ধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন উভয়েই। অভিযোগ রয়েছে, দীলিপের মোটা অঙ্কের টাকা মেরে দেন আনার। এটাও তদন্তে আনা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি ডিবি।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ জানান, হত্যাকাণ্ডের মদতদাতা আক্তারুজ্জামান শাহীন গত ৩০ এপ্রিল তিন জনকে নিয়ে কলকাতায় যান। সেই দলে একজন নারীও ছিলেন। কিলিং মিশন বাস্তবায়নের পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়াকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে শাহীন ১০ মে দেশে চলে আসেন। এ সময় গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার কথা জানান হারুন। ভারতীয় পুলিশও এখানে কাজ করছে। তাদের কাজ শেষ হলে ডিবির সদস্যরাও কলকাতায় যাবেন।

কী কারণে এমপিকে হত্যা করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, এ হত্যার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। কী কারণে হত্যা সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত শেষে হত্যার মূল কারণ উদঘাটন হবে।

ডিবি প্রধান জানান, হত্যার আগে তাদের পরিকল্পনা ছিল আনোয়ারুলকে জিম্মি করা। এরপর তারা আনারের আপত্তিকর ছবি তুলে তা দিয়ে দুদিন ব্ল্যাকমেইল করে হুন্ডির মাধ্যমে এবং কলকাতায় থাকা তার বন্ধুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করার  কল্পনাও করেছিলো। কিন্তু আনার কলকাতার ভাড়া করা ওই ফ্ল্যাটে যাওয়ার পরে তার মুখে ক্লোরোফর্ম (চেতনানাশক) ব্যবহার করায় তিনি জ্ঞান হারান। অজ্ঞান অবস্থায় আনারের আপত্তিকর ছবি তোলা হয়।

তিনি আরও জানানআনার হত্যার ঘটনা তদন্তে ভারতীয় পুলিশের একটি দল ঢাকায় কাজ করছে। পাশাপাশি আমাদের হাতে গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দুটি বিষয় পেয়েছি। হত্যাকান্ডে দুটি গ্রুপ এখানে কাজ করেছে। একটি গ্রুপ মদত দিয়েছে, আরেক গ্রুপ হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে কাজ করেছে।

স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি-না জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, নির্দিষ্ট করে কোনো কিছু বলা যাবে না। তবে অনেকগুলো বিষয় আছে। তদন্ত শেষ করে আমরা জানাতে পারব।

হত্যার ঘটনায় কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আলামতও মিলেনি। কিসের ভিত্তিতে হত্যার কথা বলা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, আমরা অনেক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ করছি না। প্রমাণ আছে বলেই কলকাতায় হত্যা মামলা হয়েছে। আমাদের দেশে একটি অপহরণ মামলা হয়েছে। কলকাতায় মামলাটি সেখানকার সিআইডি তদন্ত করছে। নিশ্চয়ই তারা আলামত পেয়েছে। কলকাতায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলার তদন্ত দেখতে আমারও যাবো।

ডিবিপ্রধান বলেন, হত্যাকারীরা তাকে প্রথমে অপহরণের পর ফ্ল্যাটে নেয়। এরপর তার একটি ফোন নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়। যাতে বোঝা যায় আনার অন্য জায়গায় ছিলেন। এ ছাড়াও হত্যাকারীরা তাকে হত্যার পর চারটি মোবাইল নিয়ে বেনাপোল সীমান্তে আসে। এরপর তারা হত্যায় আনারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ফাঁসাতে তাদের কলও করে।

ভারতে ডিবির টিম যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছে, ডিবির একটি টিম যেন ভারতে যায়। এ জন্য আমাদের জিও হয়েছে।

লাশ পাওয়া গেলো না, তাহলে কীসের পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা এই ঘটনাটিকে মার্ডার বলছেন; এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, এমন ঘটনা আছে, বছরের পর বছর লাশ পাওয়া যায়নি। তিন বছর লাশ পাওয়া যায়নি, এমন ঘটনাও আমাদের কাছে আছে।

এদিকে ভারতীয় এক সংবাদমাধ্যম পুলিশের বরাতে জানিয়েছে, এমপি আনারকে হত্যা ও তার মরদেহ টুকরো টুকরো করার পর সেটির পাশে বসেই খাবার ও মদ খায় খুনিরা। পুলিশের বরাতে সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, হত্যার পর আনারের মরদেহ ফ্ল্যাটের বাথরুমে নেয়া হয়। সেখানেই বসে টুকরো টুকরো করা হয় তাকে। বাথরুমে যেন হত্যার কোনো আলামত না থাকে সে জন্য কয়েকবার পানি এবং ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে এটি পরিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া রক্তের যেসব ছোপ ছোপ দাগ রুমে লেগেছিল সেগুলো মুছে ফেলতে পুরো ফ্ল্যাটটি পরিষ্কার করা হয়। সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, আনারের মরদেহের বড় বড় হাড্ডি এবং মাথার খুলি টুকরো করার জন্য চাপাতির মতো কোনো কিছু ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া কলকাতাতে আখতারুজ্জামান শাহীনের আরোও একটি ভাড়ার ফ্লাট পেয়েছে সেখানকার সিআইডি। ওই ফ্লাটে গত দুই মাস ধরে গ্রেপ্তারকৃত জিহাদ ওরফে কসাই জিহাদ অবস্থান করছিলো। ওই ফ্লাটেও আনারের আসা যাওয়া ছিলো বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

 

আমার বার্তা/জেএইচ