ওয়াসার ফকরুল দম্পত্তির হাউজিং ব্যবসা রমরমা! 

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৪, ১১:১৮ | অনলাইন সংস্করণ

  শাহীন আবদুল বারী:

ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী ফকরুল ইসলাম অবৈধ উপার্জনের টাকা বৈধ করতে স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তার নামে অনিতা ইঞ্জিনিয়ারিং হাউজিং প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ব্যবসার ধরণ হিসেবে দেখিয়েছেন এটি একটি প্রকৌশলী ফার্ম। তিনি গ্রাহকের নিকট থেকে প্লট এবং ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা  একাউন্টে নিতে রাজি নন। গ্রাহককে ফ্ল্যাট বা প্লট কিনতে হলে তাকে নগদ টাকা প্রদান করতে হবে। ফকরুল ইসলামের সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত একশ' কোটি টাকা স্ত্রী নাদিয়ার নামে লাইসেন্স নেয়া অনিতা ইঞ্জিনিয়ারিং রিয়েল এস্টেট কোম্পানির নামে খাটিয়ে রমরমা ব্যবসা করছেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকৌশলী ফকরুল ইসলাম নামে বেনামে ফ্ল্যাট, প্লট এবং অসংখ্য জমি ক্রয় করেছেন অনিতা ইঞ্জিনিয়ারিং এর নামে। তিনি সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্য সহ সব কিছুই স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তা এবং আত্নীয় স্বজনের নামে করেছেন।  ফকরুল ওয়াসায় নজিরবিহীন দুর্নীতি করে পাহাড় সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন । অত্যন্ত বিনয়ী আচরণ এবং ভদ্রবেশী এই প্রকৌশলীর স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তার মালিকানাধীন অনিতা ইঞ্জিনিয়ারিং এর বর্তমান ঠিকানা, লালমাটিয়ার সি ব্লকের ২/৮ নম্বর বাড়ির ৫/এ তে অবস্থিত। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের ৩ নম্বর সড়কের ডি ব্লকের ২৮ নম্বর ভবন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ধরণ হলো প্রকৌশলী ফার্ম। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নেয়া হয়েছে। যার ট্রেড লাইসেন্স নাম্বার-০৫-৩৭৪১৩। ফকরুল ইসলামের স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তা একজন সঙ্গীতশিল্পী। একই ঠিকানায় স্টুডিও মিউজিক ওয়েব নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই সামান্য ব্যবসা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে শতকোটি টাকার মালিক বুনে যাওয়াটাকে অভিজ্ঞ মহল স্বাভাবিক ভাবে দেখছেননা। সূত্রমতে,  মুক্তার দাবি হচ্ছে, সে বংশীয় এবং টাকাওয়ালা ঘরের সন্তান। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকৌশলী ফকরুলের অবৈধ উপায়ে অর্জিত দুর্নীতির টাকা দিয়ে অনিতা ইঞ্জিনিয়ারিং রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অবৈধ টাকা বৈধ করার নিমিত্তে  নবীনগর হাউজিং এবং ঢাকা উদ্যান- মোহাম্মদপুরে তিন টি দশ তলা এপার্টমেন্ট নির্মাণ করেেছন প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম দম্পতি। নবীনগর হাউজিং প্রকল্পের ৫ নম্বর সড়কের এফ ব্লকের  হোল্ডিং-এ, ১২ নম্বরে ছয় কাঠা জমির উপর দশ তলা এপার্টমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ২ নম্বর সড়কের সি ব্লকের ৩১ নম্বরের এপার্টমেন্টিও দশ তলা বিশিষ্ট। একই প্রজেক্টের ৩ নম্বর সড়কের ডি ব্লকে ২৮ নম্বরে  নির্মাণ করা হয়েছে দশতলা আলিশান আরো একটি ভবন। এরইমধ্যে নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর ভবনের সব'কটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এর একটি ফ্ল্যাটে থাকেন ফকরুলের বায়রা লিমন। ২৮ নম্বর ভবন টিও বিক্রির জন্য রেডি করা হয়েছে। আর ৩১ নম্বর ভবন টি মেরামতের কাজ চলছে। এছাড়াও মোহাম্মদপুরস্থ লালমাটিয়ার  সি ব্লকের ২/৮ নম্বর হোল্ডিংয়ের আটতলা ভবনে স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তার নামে রয়েছে অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট। নবীনগর হাউজিংয়ের এক নম্বর রোডে একটি প্লটের মালিক ফখরুল ইসলাম দম্পতি । সেখানে টিনশেড ঘর তৈরি করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। নবীনগর হাউজিংয়ের প্লট এবং লালমাটিয়ার ফ্ল্যাট টি স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তার নামে বলে জানানো হয়েছে। 

ফকরুলের স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তা সব সময়  দামী গাড়িতে চড়েন। চলাফেরার জন্য সরকারি গাড়ি সহ ৪/৫ টি দামী গাড়ি ব্যবহার করেন ফকরুল দম্পতি । এছাড়াও সন্তানদের বিদেশে লেখাপড়া, বিদেশ ভ্রমণ, বিলাশবহুল জীবন যাপন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে বহিরবিশ্বে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে প্রকৌশলী ফকরুলের বিরূদ্ধে।। 

প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর  ঢাকা উদ্যান বহুমুখী সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির ইলেকশনে ২৯৬ ভোট পেয়ে সদস্য পদে নির্বাচিত হন বলে খবর জানা গেছে।

ঢাকা উদ্যানের ৩ নম্বর সড়কের ডি ব্লকের ২৮ নম্বরে  ৬ কাঠার উপর নির্মিত দশ তলা আলিশান ভবনটিতে  সরজমিনে গিয়ে উপস্তিত লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়,  ওই বাড়িটি এক বছর আগে নির্মাণ করা হয়। কিছু ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়েছে। বাকি সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া হয়েছে। বাড়ির কেয়ারটেকার সাত্তার জানান, প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট করা হয়েছে। দশ তলার ইউনিটে ভবনের মালিক ফকরুল ইসলাম থাকেন। ভবনটি ফখরুল ইসলাম এর নিজের বলে জানান সাত্তার। ফ্ল্যাটের সাইজ- ১১০০ স্কয়ার ফিট। প্রতি স্কয়ার ফিট এর মূল্য ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৪শ' ৫৪ টাকা। ৮ম ও ৯ম তলা এক ইউনিট করে বিক্রির কথাও জানানা তিনি।  

 নবীনগর হাউজিং এর ৫ নম্বর রোডের ১২ নং কমলা রঙের বাড়িতে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মী খোকনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ফকরুল ইসলাম  অনেক আগেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন। আর বাড়িটি যৌথ মালিকানায় নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থানীয় লোক জনের সাথে কথা হলে তারা জানান, ভবন টি ফকরুল ইসলামের। তার বায়রা লিমনও এই ভবনে থাকেন। দ্বিতীয় তলায় মেডিসিন ব্যবসা এবং অনলাইন ব্যবসা রয়েছে বলে জানান তারা। এদিকে ঢাকা উদ্যানের ৩ টি দশ তলা ভবনের দায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকারের ভাষ্য অনুযায়ী, নবীনগর হাউজিংয়ের ৫ নম্বর সড়কের ১২ নম্বর হোল্ডিংয়ের ভবনের মালিক ফকরুল ইসলাম নিজেই। ভবনের মেইন ফটকে ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে। স্থানীয়দের কাছে চাউর আছে, লিমন মেডিসিন ব্যবসা এবং অনলাইন ব্যবসা করে এই ভবনটি নির্মাণ করেছেন। জনমনে প্রশ্ন, মাত্র এক বছরের মধ্যেই এই মেডিসিন এবং অনলাইন ব্যবসা করে এতো বড়ো ভবন নির্মাণ করা কিভাবে সম্ভব?  তাদের আরো অন্য আয়ের উৎস কি তা জানতে চায় এলাকাবাসী। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ফকরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তার অহংকার এবং দাম্ভিকতায় কেউ এই দম্পত্তির সাথে কথা বলতেও ভয় পায়। এতো অর্থ এবং সম্পদের পেছনে কার সহযোগিতা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার দাবিও জানিয়েছেন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় ,  ফকরুল ইসলামের বড়ো ভাই ফিরোজ আহমেদ  এর শ্যামলীতে একটি ফ্ল্যাট আছে। সেখানে তিনি বসবাস করেন। সন্তানরা বিদেশে লেখাপড়া করেন। ফিরোজ আহমেদ সিটি গ্রুপের এলপিজি লিমিটেড এর পরিচালক এবং প্যাট্রোম্যাক্স  এলপিজির সি,ই,ও। ফকরুল ইসলাম শুধু নিজের পরিবারের জন্য ধন সম্পদ করেছেন এমন নয়। তিনি শশুর বাড়ির লোকজন এবং বায়রা লিমনের নামেও ধন সম্পদ করেছেন।

ঢাকা ওয়াসার একাধিক সুত্র মতে, ফকরুল ইসলাম কাউকেই তোয়াক্কা করেননা। তিনি সব সময় মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন। থাকেন সব সময় ধরাছোয়ার বাইরে। সবাইকে  সতর্কবার্তা দিয়ে রাখা হয়েছে, তার বিষয়ে সাংবাদিক তথ্য জানতে চাইলে কেউ যেন মুখ না খোলেন। 

ফকরুল ইসলামের পারিবারিক এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ধরে তোলা হলোঃ- তিনি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে মেঝ। বড় ভাই ফিরোজ আহমেদ সিটি গ্রুপের পেট্টোম্যাক্স এল,পি,জি লিমিটেড এর সি,ই, ও। তিনি ঢাকার শ্যামলীতে বসবাস করেন। ছোট ভাই কম্বোডিয়াতে খামাড়ের ব্যবসা এবং কেমিস্ট। ফকরুল ইসলাম পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে এনভয়রনমেন্টাল সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। ফকরুলের বড় ছেলে অরিত্র ২০২৩ সালের ১৮ জুন উচ্চতর ডিগ্রিতে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। অরিত্র সেখানে  ইউ, টি, এস ইউনিভার্সিটিতে  পড়াশোনা করেন বলে জানা গেছে। 

অভিযোগ উঠেছে, সন্তানকে বিদেশ লেখাপড়া, সপরিবারে মাঝে মধ্যেই বিদেশ ভ্রমণ, আলিশান জীবন যাপন এবং দামী গাড়িতে চলাফেরার জন্য মাসিক বেতন ভাতার চেয়ে দশ গুণ খরচের টাকা কোথা থেকে আসে? ফকরুল ইসলামের অবৈধ উপার্জন কি পরিমাণ আছে তা তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী মহল।

ফকরুল ইসলামের অবৈধ আয়ের টাকায় হাউজিং ব্যবসা সহ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, লালমাটিয়ার ফ্ল্যাট টি তার শশুর বাড়ি থেকে চাকরির আগেই যৌতুক হিসেবে পেয়েছেন। স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তা একজন সঙ্গীতশিল্পী। মুক্তা স্বনামধন্য ও ঐতিহ্যবাহী বংশের মেয়ে। অপর এক প্রশ্নবানে তিনি জানান, আমার নিজের কোন সম্পদ বা জমিজমা নেই। আমি শশুর বাড়িতে থাকি। আমার  নিজ গ্রামেও কোন জায়গা জমি ক্রয় করিনি।

এদিকে ১৩ জুলাই ক্রেতা সেজে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঢাকা উদ্যানে সরজমিনে গিয়ে ফকরুল ইসলামের সাথে সামনাসামনি আলাপ হয়। এসময় ফকরুল ফ্ল্যাট বিক্রির কথা শুনে অকপটে বলতে থাকেন এই ব্যবসা আমাদের চার ভাই বোনের যৌথ প্রতিষ্ঠান। রাজউকের অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, না। তবে, ফ্ল্যাট কিনলে ফকরুল ইসলাম নিজে দলিল করে দিবেন বলে জানান। ফ্ল্যাটের দাম নিয়ে কথা হলে বলেন, প্রতি স্কয়ার ফিট ৪,৯০০ টাকা। কিন্তু একাউন্টে টাকা নিতে নারাজ তিনি । ফ্ল্যাট কিনলে ক্যাশ টাকায় কিনতে হবে। তবে শেষে একাউন্টে টাকা নিতে রাজি হন ফকরুল ইসলাম। সাথে শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেন, স্কয়ার প্রতি ৩৫০০ টাকা করে ব্যাংকে জমা দিবেন। বাকী টাকা ক্যাশ দিবেন। কেন বাকি টাকা ক্যাশ দিতে হবে জানতে চাইলে তড়িঘড়ি করে চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। 

 

আমার বার্তা/এমই