মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে ২০ হাজার কোটি লুটের টাকা উদ্ধার হয়নি
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১৫:৪১ | অনলাইন সংস্করণ
শাহীন আবদুল বারী:
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালসহ তিন এমপির বিরুদ্ধে ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগটি এবার সামনে এসেছে। দুদক তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা কার শেল্টারে ত্রিশ হাজার শ্রমিকের জীবন নষ্ট করে ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এর রহস্য উদঘাটন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মালয়েশিয়া চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভুক্তভোগীরা টাকা ফেরত পাবেন। অন্যথায় এই গরীব অসহায় মানুষ গুলো টাকা ফেরত পাবার কোন আশঙ্কা নেই বলে মনে করেন অভিবাসন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশের ইতিহাসে মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানোর নামে সবচেয়ে বড়ো আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছে এই সিন্ডিকেট। কর্মী পাঠানোর নামে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লুট করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে তিন দশক ধরে চলছে এই লুন্ঠন।
এদিকে বায়রার একটি সূত্র জানিয়েছে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ৭০ ভাগ কর্মীর টাকা ফেরত দিয়েছেন। তবে কাগজে কলমে হিসাব জানাতে পারেনি বায়রা। অপরদিকে এক জুলাই মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নামে অর্থ লুটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। ওই রীটে বলা হয়, ৩০ হাজারের বেশি যুবককে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা সাত দিনের মধ্যে জবাব চাওয়া হয় রাষ্ট্রপক্ষের কাছে।
জানা যায়, বিদেশ লোক পাঠানোর নামে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রিক্রুটিং লাইসেন্স নেন ফেনী থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী। তার প্রতিষ্ঠানের নাম স্নিগ্ধ ওভারসীজ লিমিটেড। মালয়েশিয়া চক্রে যোগদেয়ার পর দেড় বছরে দেশটিতে ৭,৮৪৯ জন শ্রমিক গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির নামে। নিজাম হাজারীর মতো আরো সংসদ সদস্য বেনজির আহমেদ এর আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল ৭.৮৪৯ জন কর্মী, লেফটিনের জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল ৮,৫৯২ জন কর্মী এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল এর অরবিটলস ইন্টারন্যাশনাল ২,৭০৯ জন কর্মী মালয়েশিয়া পাঠিয়েছেন। এসব শ্রমিক পাঠাতে সরকারি ভাবে জনপ্রতি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, ৭৮,৯৯০ টাকা। আর গড়ে নেয়া হয়েছে ৫,৪৪,০০০ টাকা। লুটেরা শ্রমিকদের পাঠানোর পর দেশটিতে গিয়ে চাকরি পেতে হয়রানির শিকার হোন। আবার কেউ জেল-জুলুমের শিকার হয়ে দীর্ঘসময় কারাগারে থাকতে হয়। অস্থির হয়ে উঠে শ্রম বাজার। বাংলাদেশ সহ ১৪ টি দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠায়। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া কোন দেশেই এমন চক্র নেই। এই চার সংসদ সদস্য ছাড়াও আওয়ামী লীগ, সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলর এবং নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ায় লোক পাঠিয়েছে। চক্রের সদস্যরা ক্ষমতাধর হয়ায় অনেক পুরোনো প্রতিষ্ঠানের জায়গা হয়নি।
মালয়েশিয়া চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ টি জানতে চার সংসদ সদস্যের অফিস সহ সম্ভাব্য জায়গায় খোজ নিয়ে তাদেরকে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের অফিস থেকে জানানো হয়েছে, তারা সবাই দেশের বাইরে আছেন। আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা পালানোর আগেই তারা পরিবার পরিজনদের নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। ভুক্তভোগীদের দাবি সরকারের কাছে এই এজেন্সি গুলোর বিদেশ লোক পাঠানোর সকল কাজ বন্ধ রাখা হোক।
বায়রা সদস্যদের অভিযোগ, চক্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন। এই চক্রের ১০০ টি এজেন্সির মধ্যে ৬৯ টির নাম ঠিক করেছেন রুহুল আমিন। রুহুল আমিনের বক্তব্য জানতে অনেক চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বায়রার লোকজন জানিয়েছেন পুরো চক্রের সদস্যরাই গাঢাকা দিয়েছেন। মূলত এই চক্রটি শ্রম বাজারকে অস্থির করে তোলেন। গরীব অসহায় মানুষ জমি, ভিটা বাড়ি, গহণা বিক্রি এবং সুদে টাকা এনে তাদের এজেন্সিতে জমা দেয়া টাকা লুট করেছে লুটেরা। শুধু মাত্র পরিবার পরিজনদের নিয়ে একটু সুখের আশায় লোকজন বিদেশ যেতে নিজের সব সম্বল বিক্রি করে দালালদের মাধ্যমে টাকা দেন। আর তাদের টাকায় গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন বিশাল একটি চক্র। এদের কারণে হাজার হাজার মানুষ রাস্তার ফকির হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। সুদের টাকার ঘানি টানতে অনেক শিক্ষিত যুবক রাজধানীতে রিকশা, ভ্যান, শাক-সবজি এবং দিনমুজুরের কাজ করছেন। তাদেরই একজন ময়মনসিংহের আতাউর। জানালেন তার জীবনের করূন কাহিনী। যতটুকু যায়গা ছিলো তা বিক্রি করে এবং সুদে টাকা নিয়ে মালয়েশিয়া যাবার জন্য টাকা দিয়ে বিদেশ না যেতে পেরে এখন রিকশা চালান। তার মতো অনেক যুবক একই পথের পথিক। অনুমোদন ও ভিসা পাওয়ার পরও কয়েক হাজার বিদেশগামী লোকের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সীর (বায়রা) মধ্যে সমন্বয় হীনতা ও সিন্ডিকেট করে লোক পাঠানোকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, লোটাস কামালরা মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে ' অসম আদান প্রধানের' কারণেই এটা তৈরী হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের হাত এতোই লম্বা যে, তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন দপ্তর গুলো কোন ব্যবস্থা নিতে ভয়ে তটস্থ থাকতো। আর মোটা টাকার বিনিময়ে উচ্চ পদস্থরা চুপ মেরে থাকতেন। সূত্রমতে, মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর জন্য যেসব এজেন্সি এবং ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের তালিকা প্রস্তত করে ব্যবস্থা নেয়ার উপযুক্ত সময় এখন। অতীতে প্রভাশালী এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নেননি। সরকারের শীর্ষ-এ থাকা অনেক মন্ত্রী, এমপি, সচিব, আমলা, রাজনীতিবিদ রাঘববোয়াল এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের অধিকাংশ পালিয়েছেন। আর যারা আছেন তারা নানাভাবে তদবির চালাচ্ছেন বাচার জন্য। সাবেক প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ওই সময় বেশ হাকডাক ছেড়ে বলে ছিলেন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আসলে সেটি ছিলো শুধু মাত্র আইওয়াস। তিনিও ওই সিন্ডিকেটের বাইরে নয় বলে বায়রা সূত্রে জানা যায়।
অভিযোগে প্রকাশ, এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ রয়েছে। ততকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসনের প্রধান দোসর ছিলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই সিন্ডিকেট কে সহায়তা দিতে গণভবন থেকে সরাসরি নির্দেশ প্রদান করার অভিযোগও রয়েছে। এসব কিছুই উদঘাটন করে সরকার দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে এমনটাই আশা করছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশাদার মানুষ।
এদিকে সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল ১৬ বছরে একতছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিলেন শ্রমবাজারের উপর। ২০২২ সালে বায়রার নির্বাচনে জয় পায় মোহাম্মদ নূর আলী-মোহাম্মদ আবুল বাশার সমর্থিত প্যানেল। জয় পাবার পর তারা চেষ্টা করেন শ্রমবাজারের অস্থীরতা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে বাদ পড়া ৩০ হাজার শ্রমিক তাদের ক্ষতি পূরণ ফিরে পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ সিন্ডিকেটের সদস্যরা পলাতক। তাছাড়া এ সরকার কতটুকু ব্যবস্থা নিবেন সেটা নির্ভর করে সরকারের উপর। তবে নতুন করে আশারবাণী দেখছেন বিজ্ঞমহল।
এদিকে আরেকটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিদেশ যেতে শ্রমিকদের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যাংক কতটুকু সহযোগিতা দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।আর যাও দিয়েছে তার লাভের পরিমাণ কি ছিলো সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি। এই ব্যংকটি চালু করা হয়ে ছিলো একমাত্র বিদেশ ইচ্ছুক দের সহযোগিতা জন্য। অথচ দালানদের মাধ্যমে বিদেশ যেতে কতো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে শ্রমিকদের।
অপরদিকে শ্রমিক পাঠানোর ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আলাদা একটি 'সাইবার পুলিশ ইউনিট' গঠন করার পরিকল্পনা ছিলো। কথা ছিলো বাদ পড়া শ্রমিকদের তালিকা প্রস্তত করে তাদেরকে সহায়তা দেয়া হবে। একই সাথে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ব্যর্থতার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্ত ক্ষমতাধরদের দাপটে সব ভেস্তে গেছে।
এদিকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ পাচ্ছেনা। তাদেরকে যে ভিসায় নেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। সেখানে অবস্থিত সিন্ডিকেটের নিযুক্ত বাংলাদেশী দালালরা ওই দেশীয় দালালদের সাথে যোগসাজস করে প্রতিবাদী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ গুরুতর। বিদেশে বসে এসব দালালরা শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের ভিডিও দেশে পাঠিয়ে তাদের আত্নীয় স্বজনদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আরো লাখ টাকা দাবি করেন। আবার কাউকে ফোনে ধরিয়ে দেয়া হয়। বিদেশ বসে সন্তানদের কান্নার আহাজারি শুনে দালালদের নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে অভিভাবকরা টাকা দিতে বাধ্য হন। মালয়েশিয়ার কারাগারে অনেক যুবক বন্দী আছেন। তাদের সুরক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি। অভিভাবকরা সংশ্লিষ্ঠ এজেন্সি এবং দালালদের কাছে গিয়েও কোন সুরাহা পাচ্ছেননা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া সরকার যখন শ্রমিক যাওয়া বন্ধ করে ওই সময় ৫২ হাজার কর্মী যেতে পারেনি। আর এই সংকট গুলো আসলে এয়ারলাইন্স গুলো পুরোদমে সুযোগ গ্রহণ করে। এবারও তারা এই সুযোগ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে মানবপাচার ও হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করে মালয়েশিয়া সরকার। এরপর ২০২২ সালে আবারও শ্রমবাজার খুলে দেয় দেশটি।
প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে যেসব এজেন্সি “মালয়েশিয়া কেলেঙ্কারির” সাথে জড়িত হয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এমন প্রত্যাশা করছেন ভুক্তভোগী পরিবার গুলো।
আমার বার্তা/এমই