মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছেন মিতুর মা শাহেদা মোশাররফ।
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) চট্টগ্রাম তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে সাক্ষ্য দেন তিনি। সাক্ষ্যে বলেন, ‘মিশন শেষ করে ফিরে এসেই বাবুল চীনে চলে যায়। সেখানে বসেই মিতুকে মারার পরিকল্পনা করে। মিতুকে খুন করার জন্য মুসাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে দেয়, মুসার স্ত্রী এ কথা বলেছেন। আর ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারীর সঙ্গে বাবুলের বিয়েবর্হিভূত সম্পর্কের জেরেই মিতুকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।’
সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দফায় দফায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিতুর মা শাহেদা। মিতু হত্যা মামলার ৪৯তম সাক্ষী হিসেবে আদালতকে তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে বাবুল আক্তারের মা মারা যাওয়ার ১৫ দিন আগে আমাকে কল করেন। বলেন- বেয়াইন, মিতুকে আমার ছেলে খুন করেছে। তাকে আপনি মাফ করে দেন। আমি তাকে বলি- বাবুল মরলে কি এ কথা আপনি বলতেন? এসব আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে বলেছি। তদন্তে সবকিছু উঠে আসেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বড় মেয়ে মাহমুদ খানম মিতুর ২০০২ সালের ২৬ এপ্রিল বাবুল আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়। তখন বাবুল আক্তার বেকার ছিল। বিয়ের পর একেবারে শুরু থেকে তাদের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। বাবুল পরে পুলিশে যোগদান করে। এরপর কক্সবাজারে এসপি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) হিসেবে বদলি হয়। সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। একদিন বাবুল আক্তার মিতুকে নিয়ে কক্সবাজারের একটি হোটেলে ওঠে। পাশের রুমে ওই নারীও ওঠে। ওই নারীর রুমে বাবুল আক্তারকে আপত্তিকর অবস্থায় মিতু দেখে ফেলে। তখন মিতু তাকে জিজ্ঞেস করে, সে এখানে কী করছে? বাবুল মিতুকে বলে, বিদেশে যাবার জন্য ল্যাপটপে কাজ করছে। তাদের দুজনকে এ অবস্থায় দেখে মিতুর খুব খারাপ লাগল। সে কিছুক্ষণ ওখানে ছিল। বাচ্চারা একা থাকায় মিতু তাদের রুমে চলে আসে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সেও ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ৩টার দিকে মিতুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখনও বাবুল আক্তার মিতুর রুমে ছিলেন না। মিতু আবার ওই নারীর রুমে গেলে তাদের দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়। মিতু রুমে এসে কেঁদে কেঁদে আমাকে ফোন দেয়। তখন আমি তাকে বলি, তুই চলে আয়। মিতু তখন বলে, আমার ছেলে-মেয়েরা আমাকে খারাপ মনে করবে। তাই আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি।’
সাক্ষ্যে শাহেদা বলেন, ‘বাবুল ২০১৪ সালে মিশনে যায়। মিশনে যাওয়ার সময় তার একটি মোবাইল বাসায় রেখে যায়। ওই মোবাইলে বাবুল আক্তারকে দেওয়া ওই ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারীর মেসেজ খুঁজে পায় মিতু। একইসঙ্গে বাবুলকে ওই নারীর উপহার দেওয়া দুটি ইংরেজি বই পায়। মিতু মেসেজগুলো দুটি বড় পৃষ্ঠা ও দুটি ছোট পৃষ্ঠায় লিখে রাখে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার ছোট মেয়ের বাসায় মিতু ও তার ছেলেমেয়েরা বেড়াতে যায়। মিতু তখন আমাকে পৃষ্ঠায় লেখা মেসেজগুলো দেয়। এসব কিছু আমাদের বলায় বাবুল মিতুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। এরপর মিতু তিন-চারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে।’
মেয়ের ওপর বাবুলের অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে শাহেদা মোশাররফ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, ‘মিতু চট্টগ্রামের বাসা থেকে ঢাকায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। ২০১৬ সালের জুনের ৪ তারিখ রাতে মিতু আমাকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে বলে, আম্মা মাহিরের স্কুল থেকে মেসেজ এসেছে। আমাকে খুব ভোরে মাহিরকে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে। ৫ জুন সকালে মিতুর বাসার পাশ থেকে একজন মহিলা আমাকে ফোন দেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই সকালে এক মহিলা আমাকে কল করে বলেন- মিতু গাড়ির সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। আমি বলি, মা তুমি মিতুকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাও। আমি টাকা নিয়ে আসছি। এরপর মাহির একজনের মোবাইল থেকে কল দিয়ে বলে- নানু, আম্মুকে সন্ত্রাসীরা কোপায়ছে, গুলি করছে। তখন আমি মাহিরকে বলি, তোমার আম্মু কি কথা বলছে? মাহির বলে, না আম্মু তাকিয়ে আছে শুধু। আমি মাহিরকে বলি, তুমি তোমার বাবাকে কল দিয়েছ? মাহির বলে, হ্যাঁ নানু, ফোন দিয়েছি, তবে বাবা কথা বলে না। আমি মাহিরকে বলি, তোমার আম্মুকে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখো। এরপর আমি, আমার ছোট দুই দেবর, জা ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ফ্লাইটে চট্টগ্রামে চলে আসি। মিতুকে যেখানে খুন করা হয়েছে, আমি সেখানে যাই। এরপর আমি মিতুর বাসায় আসি। ওখানে শুনি মিতু (লাশ) হাসপাতালে আছে।’
শাহেদা বলেন, ‘বাসায় যাওয়ার পর মাহির আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলে, নানি আমার মা চলে গেছে। মিতুকে (লাশ) এরপর হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয় পুলিশ লাইনে। সেখানেই তার জানাজা হয়। পরে আমার দুই দেবর মিতুর লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা নিয়ে যায়। আমরা ফ্লাইটে করে ঢাকা যাই। এরপর আমাদের বাড়ি মেরাদিয়াতে মিতুর জানাজা শেষে সেখানে তাকে দাফন করা হয়।’
এ সময় তিনি তথ্য দেন, মিতু মারা যাওয়ার পর ছেলে মাহির তিনবার করে করে বাবুল আক্তারকে। কিন্তু বাবুল কল রিসিভ করলেও কোনো কথা বলেনি। শাহেদাও একবার কল দিয়েছিলেন, কিন্তু রিসিভ করেনি।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। খুনের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা হয়। ওই বছরের ১০ অক্টোবর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। ২০২৩ সালের ১৩ মার্চ আসামিদের বিচার শুরু হয়। ৯ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। আজ শাহেদা মোশাররফের আগে সাক্ষ্য দেন অবসরে যাওয়া পুলিশ পরিদর্শক মহিউদ্দিন মাহমুদ, তিনি তৎকালীন পাঁচলাইশ থানার ওসি। আগামীকাল বুধবার সাক্ষী শাহেদাকে জেরা করবেন আসামি বাবুল আক্তারের আইনজীবী।
আমার বার্তা/এমই