তামাক একটি মরণব্যাধির সূচনা। তামাক সেবন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তামাক ব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এছাড়াও সরাসরি তামাক গ্রহণ ও ধূমপানে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ব্যাধিসহ মুখ, গলা, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলীর মতো একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে এবং ২০টিরও বেশি ধরনের ক্যানসার রোগ ঘটায়।
আজ ৩১ মে, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য— “তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।” এই প্রতিপাদ্য ধারণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংগঠনগুলো তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মসূচির আয়োজন করছে।
তামাক বিপুল মৃত্যু এবং ব্যাধির উৎস হওয়া সত্ত্বেও নানা ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। প্রতিনিয়ত বাহারি মোড়ক ও নিত্যনতুন স্বাদ-গন্ধ ব্যবহার করে নতুন প্রজন্মের কাছে তামাকপণ্যের জীবনক্ষয়ী চরিত্র আড়াল করা হয়। একইসঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নানামুখী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে কোম্পানিগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক মূলত সাদা শলাকায় কালো বিষ। আর এই বিষবাষ্পের ফাঁদে পড়ছে তারুণ্য।
এমন প্রেক্ষাপটে তামাকজাত পণ্য সেবনে সচেতনতা তৈরিতে সারা বিশ্বের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৫। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।’ এ উপলক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তিনি বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলো তরুণ প্রজন্মকে প্রলুব্ধ করতে নিত্যনতুন তামাকপণ্য আকর্ষণীয় প্যাকেজিং ও ডিজাইনে বাজারজাত করছে। আমাদের যুব সমাজকে তামাকজাত পণ্য থেকে দূরে রাখতে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমান মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী। কোম্পানির মূল টার্গেট কিভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তামাকে আসক্ত করে ব্যবসা বাড়ানো যায়। এছাড়া দেশে প্রায় ৪ কোটি (৩৫ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এ কারণে দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেন বছরে আরও প্রায় ৪ লাখ। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতা এসডিজির ৩য় লক্ষ্যমাত্রা-সুস্বাস্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।
জানা যায়, বাজারে ১৬ হাজারের বেশি সুগন্ধযুক্ত তামাকপণ্য (ই-সিগারেট, সিসা এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য) রয়েছে। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের আকৃষ্ট করতে বাবলগাম, চেরি, চকলেট ইত্যাদি সুগন্ধীর তামাকপণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে শিশুখাদ্য আর তামাকের ফারাক করতে পারছে না অনেক শিশু, সুগন্ধীর লোভে পড়ে স্বাস্থ্য ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করে হাতে তুলে নিচ্ছে এসব বিষপণ্য। ইউএসবি স্টিক, ক্যান্ডি, কলমসহ বিভিন্ন পণ্যের আদলে আকর্ষণীয় ডিজাইনে বাজারজাত করা হচ্ছে এসব পণ্য। এছাড়া চলচ্চিত্র, টিভি প্রোগ্রাম, সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন স্ট্রিমিং প্রোগ্রামগুলোতে এগুলোর চিত্রায়ণ বাড়িয়ে দিয়ে তারুণ্যকে প্রলুব্ধ করছে কোম্পানিগুলো। শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্শ্ববর্তী দোকানগুলোয় তামাকপণ্য সহজলভ্য করে তোলা হচ্ছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাকপণ্যের প্রচার ও বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের তারুণরা। প্রচলিত তামাকপণ্যের ক্রমবর্ধমান প্রচারণার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেদার চলছে ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিং পণ্যের প্রচারণা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছে ই-সিগারেট এবং ভ্যাপ পণ্যের ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেন্ডস্টা) এবং এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ভয়েজ অব ভেপারস।
তামাক নিয়ে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করা দরকার। এছাড়া বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্ত, ই-সিগারেটসহ সব ভ্যাপিংপণ্য নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সিগারেটের সহজলভ্যতা কমাতে নিম্ন স্তর এবং মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে মূল্যান্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ৩টিতে নামিয়ে আনতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩-এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করতে হবে। স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ব্যবহার করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি/কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তামাক কোম্পানিতে সরকারের বিদ্যমান শেয়ার/বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হবে। ১৯৫৬ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে সিগারেটকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তামাক ও নিকোটিন পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচার ও বাজারজাতকরণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস-২০২৫’ উপলক্ষ্যে শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানস’র প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ, আমিনুল ইসলাম সুজন প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তামাক চাষ নীল চাষের মতো হয়ে যাচ্ছে। তামাক কোম্পানিগুলো কুষ্টিয়া, রংপুর, বান্দরবানসহ বিভিন্ন জেলায় তামাক চাষ করতে চাষিদেরকে প্রলুব্ধ করছে। শুধু কর বাড়ালেই তামাক নিয়ন্ত্রণ হবে না। তামাক চাষিদের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া তামাক কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা কমাতে হবে। এবং বিগত দিনে যেসব আমলা তামাক কোম্পানির স্বার্থে কাজ করে তামাক রপ্তানি কর তুলে দিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনসহ সব ধরনের ই-সিগারেট আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে।
এমনকি তামাক কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিমালা, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। তাদের প্রধান টার্গেট আমাদের সন্তান! শিশু-কিশোর ও তরুণদের অর্থাৎ আগামী প্রজন্মকে তারা নেশার ফাঁদে ফেলে মুনাফার পাহাড় গড়ার নেশায় আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এবং সেটা ঠিক এমন সময়ে, যখন বাংলাদেশ ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’র সুফল পেতে চলেছে।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদঅভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক ও অশনিসংকেত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত ‘গ্লোবাল স্কুল বেজড স্টুডেন্ট হেলথ সার্ভে- ২০১৪’ গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এই সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)। শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
আমার বার্তা/এল/এমই