স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সরকার। সে পথ অনুসরণ করে পরবর্তী সকল সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতি কৌশল গ্রহণ করেছেন। এগুলোর সফল বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এছাড়া নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক মাধ্যমিক শিক্ষায় নয় জেন্ডার সমতা আনয়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার হ্রাস, টিকা প্রদানের কভারেজ বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধসহ দারিদ্র হ্রাস ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নারীর প্রতি বৈসম্য রোধ এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। গ্লোবাল জেন্ডার গেপ রিপোর্ট ২০২৪ অনুযায়ী বিশ্বে জেন্ডার বৈষম্য সূচকে ১৪৬ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৯ তম অবস্থান অর্জন করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সুবিধা বঞ্চিত মহিলাদের তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা, স¦াস্থ্য,কৃষি,ব্যবসা,জেন্ডার ও আইনী সহায়তাসহ দৈনন্দিন সমস্যা সমাধান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সহায়তা সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। তথ্য আপা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস ”লাল-সবুজ ডট কম” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারীরা এ প্ল্যাটফর্মে তাদের উৎপাদিত ও সংগৃহীত পণ্য বিক্রয় করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৪ হাজার ৫০০ জন উদ্যোক্তা এ প্লাটফর্মে নিবন্ধন করে পণ্য বিক্রয় করছেন। একই সাথে আইসিটি ভিত্তিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের আত্মকর্মসস্থানের ব্যবস্থা ও উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের টেকসই ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য ”হার পাওয়ার” প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া জয়িতা ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা তৈরী ও তাদের দক্ষতা উন্নয়নের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। গ্রামীণ দুস্থ ও অসহায় মহিলাদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ক্ষুদ্র্ঋণ তহবিল কার্যক্রম চলমান রয়েছে।প্রাপ্ত বরাদ্দ দ্বারা ঘূর্ণায়মান আকারে ৬৪টি জেলার ৪৮৮টি উপজেলায় মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারের বিশেষ তহবিল হতে বেকার ও উদ্যোগী মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সম্পদ তৈরীর সুযোগ সৃষ্টি করা ও উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার লক্ষ্যে ্ঋণ বিতরণ কার্যক্রম এবং আয় বর্ধক ও উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রদান আগামীতেও অব্যাহত রাখবে সরকার।
নারী ও শিশুর সুরক্ষা:
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ভিজিডি কার্যক্রমের মাধ্যমে ১ কোটি ২২ লক্ষ নারীকে পুষ্টি চাল ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৯৭৮ জন গ্রামীণ দুস্থ ও অসহায় মহিলাদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ১২৫টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে ৯ হাজার ৩০ জনকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে কর্মজীবী মায়েদের সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। দরিদ্র মহিলাদের মাঝে ২৮ হাজার ৮২৫টি সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে । তাছাড়া ৯৯ হাজার ৩৬৮ টি সমিতিকে ১৪৭ কোটি ৮৫ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করা হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদেরকে জেলা সদর হাসপাতাল এবং ১৪টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল থেকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার ও রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার হতে ২৯ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও শিশুকে মনোসামাজিক কাউন্সিলিং প্রদান করা হয়েছে। ন্যাশনাল হেল্পলাইন ১০৯ এর মাধ্যমে ২০২৪ পর্যন্ত ৬৫ লক্ষ ৪১ হাজার ১৫৩ জন নারী ও শিশুকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতাসহ অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সকল কর্মকান্ড থেকে নারীদের নিজেকে রক্ষার লক্ষ্যে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতন করার পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে ও অবহিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারাদেশে সুবিধা বঞ্চিত কিশোর ও কিশোরীদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর পরিস্থিতি যেমন বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, যৌতুক,যৌন নির্যাতন, মাদকাসক্তি ইত্যাদি থেকে সুরক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ৭ হাজার ৩৩ টি ক্লাব চলমান রয়েছে। এ সকল ক্লাব শিশু নির্যাতন, বিশেষ করে কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, স্কুলগামী ছাত্রীদের নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, কিশোরী ক্ষমতায়ন এবং সহজে পথ চলার জন্য বাইসাইকেল প্রদান করা হচ্ছে।
আগামীতে নারী উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নারী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, শ্রম বাজারে নারীদের প্রবেশ বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা, সহিংসতা প্রতিরোধ ইত্যাদি কার্যক্রম আরো জোরদার করবে সরকার। সে লক্ষ্যে হাওড় এলাকার সুবিধা বঞ্চিত নারীর আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি,বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদন বিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মজীবী মায়েদের শিশু সন্তানদের জন্য ৬৪ জেলায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ, ৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন, গ্রামীণ শিশুদের সৃজনশীল কাজ সংগ্রহ এবং প্রদর্শন, নিরাপদ ইন্টারনেট নিরাপদ শিশু কর্মসূচি বাস্তবায়ন ইত্যাদিসহ বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মহিলা শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫হাজার ২২২ কোটি টাকা বাজেটে পাস করা হয়েছে।
মা ও শিশু সহায়তা কার্যক্রম:
গ্রামীণ এলাকার মাতৃত্বকালীন ভাতা ও শহর এলাকার কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মসূচিকে ঢেলে সাজিয়ে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল কর্মসূচির আওতায় এম আইএস ভিত্তিক মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এ কর্মসূচির অধীনে মায়েদের মাসিক ৮০০টাকা প্রদান করা হয়।সারাদেশে মা ও শিশুদের সহায়তা প্রাপ্তি সহজ ও নিশ্চিত করতে অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। এছাড়া, এ কার্যক্রমের আওতা আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে উপকারভোগীর সংখ্যা ১৫ লক্ষ ৪ হাজার ৮০০ জন হতে ১৬ লক্ষ ৫৫ হাজার ২৮০ জনে উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
সুুবিধা বঞ্চিত ও বিপন্ন সকল শিশুর সুরক্ষায় শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে সমগ্র দেশে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।বর্তমানে গাজীপুর, চট্টগাম, রাজশাহী, খুলনা,রংপুর, বরিশাল,সিলেট ,ফরিদপুর ,কুষ্টিয়া, বরগুণা ,কক্সবাজার ,জামালপুর শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত বিপন্ন শিশুদের পরিবার বা নিকট আত্মীয় বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পুনঃএকত্রীকরণ/পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হচ্ছে।বর্তমানে এ সকল কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৮ জন ছেলে এবং ১ হাজার ২১৬ জন মেয়ে শিশু অবস্থান করছে।
বয়স্ক-বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের সুরক্ষা:
দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে সরকার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে।২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৮ লক্ষ ১ হাজার প্রবীণের জন্য মাসিক ৬০০ টাকা হারে মোট ৪ হাজার ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।আগামী অর্থবছরে ভাতাপ্রাপ্ত প্রবীণের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৬০ লক্ষ ১ হাজার জনে উন্নীত করা হবে এবং এ বাবদ ৪ ৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।এছাড়া ভাতাপ্রাপ্ত বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলার সংখ্যা বিদ্যমান ২৫ লক্ষ ৭৫ হাজার জন থেকে বৃদ্ধি করে ২৭ লক্ষ ৭৫ হাজার জনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং এ বাবদ ১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়ও দ্যা ডেইলি বেষ্ট নিউজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই