বাংলাদেশ বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সামাজিক অশান্তির এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা এবং জনজীবনের মানোন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। বর্তমান সরকারের জন্য প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রাখা। এই প্রবন্ধে, দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের করণীয় বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা হবে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাঃ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য গণতান্ত্রিক চর্চা, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। সংলাপ ও সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে নিয়মিত আলোচনা ও সংলাপ আয়োজন করতে হবে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও হানাহানি বন্ধ করতে হবে। সকল দলকে গণতান্ত্রিক উপায়ে মত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে এবং সহিংস কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমন করতে হবে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তথ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে হবে। অবশেষে, সুশাসন ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার রক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা টেকসই হবে। সুতরাং, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে সব পক্ষের দায়িত্বশীল আচরণ এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নঃ দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা অপরিহার্য। একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের জন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির ব্যবহার ও গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। দ্রুত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করলে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পাবে। দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আইন প্রয়োগে বৈষম্য ও পক্ষপাতিত্ব বন্ধ করতে হবে, যাতে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়। মাদক, সন্ত্রাস ও সাইবার অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। কমিউনিটি পুলিশিং ও সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব। সুতরাং, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাঃ মানবাধিকার ও আইনের শাসন (Rule of Law) একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের মূল ভিত্তি। এর জন্য স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা, দুর্নীতি দমন এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বাধীন ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেখানে সকল নাগরিক সমান বিচার পাবে। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতি দমন ও সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্নীতি রোধে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। মৌলিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। অবশেষে, আইনের কঠোর বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব, যা একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়তা করবে।
শিক্ষা ও সামাজিক স্থিতিশীলতাঃ শিক্ষা সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান নিয়ামক। একটি শিক্ষিত সমাজ ন্যায়বিচার, শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। শিক্ষা মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিকশিত করে, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। মানসম্মত ও সমান সুযোগসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য শিক্ষা সহজলভ্য হলে সামাজিক বৈষম্য কমবে এবং অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পাবে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ প্রচারের মাধ্যমে তরুণ সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, সহনশীলতা ও নাগরিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি তৈরি করে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতা কমিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা যদি ন্যায়বিচার ও শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলে, তবে সমাজে সংঘাত ও সহিংসতা কমবে। সুতরাং, শিক্ষাকে আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতিতে সম্প্রসারণের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতিঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি একটি দেশের বৈদেশিক নীতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক অবস্থান সুসংহত করতে কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক অপরিহার্য। শক্তিশালী কূটনৈতিক নীতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, কৌশলগত জোট এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর (যেমন: জাতিসংঘ, ওআইসি) সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সংঘাত নিরসন ও শান্তি স্থাপনে কূটনীতি কার্যকর ভূমিকা রাখে। আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করা গেলে যুদ্ধ ও বৈরিতার আশঙ্কা কমে যায়। স্মার্ট কূটনীতি ও জনকূটনীতির মাধ্যমে একটি দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা সম্ভব। সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিক্ষাবৃত্তি ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করে। সুতরাং, কার্যকর কূটনৈতিক নীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে পারে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
আমার বার্তা/আলমগীর হোসেন আকাশ/এমই