বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ত্ব, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সুশিক্ষক, গবেষক ও ছায়ানটের সভাপতি অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন আর নেই। ২৫ মার্চ ২০২৫,মঙ্গলবার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এক সপ্তাহ ধরে তিনি এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে সন্জীদা খাতুন ডায়াবেটিস,নিউমোনিয়া এবং কিডনি রোগে ভুগছিলেন। সন্জীদা খাতুনের ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ জানিয়েছেন, প্রয়াত সন্জীদা খাতুনের প্রতি সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদন আগামীকাল ২৬ মার্চ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে অনুষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন, বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত এক নাম এবং প্রতিষ্ঠানও হয়ে উঠেছিলেন। সন্জীদা খাতুনের বিপুল কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন সামগ্রিকভাবে বাঙালির মানস ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার পরম সৌভাগ্য যে, ছায়োনটের কল্যাণে তাঁর ছাত্র হওয়ার, ক্লাস করার সুযোগ হয়েছে আমার। আমাদের সনজীদা আপা জীবনভর অশুভের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন কল্যাণের কথা। মানবিক ও মুক্ত সমাজ বিনির্মাণে রেখে চলেছেন অনন্য ভূমিকা। সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন সম্প্রীতির পথে। সুরকে হাতিয়ার করে লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সম্প্রীতি ও প্রগতির দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কেটেছে তাঁর প্রতিটি দিন। তাঁর বিভিন্ন জন্মদিনে উপস্থিত থেকেছি ছায়ানটে। জন্মদিন নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস ছিলো না তাঁর মাঝে। বলেছিলেন, ‘জন্মদিন আমার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। এটা একটা জৈবিক ব্যাপার, এমনই কোনো একদিন জন্মেছিলাম। আরেকটু বুড়ো হয়ে গেলাম এই আর কি!’
মনে পড়ে ভারত সরকারের সম্মানসূচক ‘টেগোর অ্যাওয়ার্ড ফর কালচারাল হারমোনি’ সম্মাননা গ্রহণকালে ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুনের অনন্য উপস্থাপনা আমার মতোন অনেককেই ভীষণ মুগ্ধ করে। উল্লেখ্য, সংস্কৃতি অঙ্গনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালের সম্মাননার জন্য নির্বাচিত হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। এই প্রথম দেশের বাইরের এবং এই প্রথম কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করে ভারত সরকার। সম্মাননা গ্রহণ করে ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি ভাষণ শুরু করেন রবীন্দ্রনাথেরই শান্তি ও মৈত্রীর আহ্বানের একটি গানের দু’লাইন গেয়ে। ছায়ানটের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন পূর্ববাংলার সার্বিক বঞ্চনার তথ্য তুলে ধরে দেশবাসীকে জাগালেন, তখন সংস্কৃতিক্ষেত্রে স্বাধীনতা আর স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রামে আমরা ছিলাম তাঁর সহযাত্রী।’ তিনি বলেছিলেন,‘ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনালগ্ন। ভাষা-আন্দোলনের বিজয়-ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির রক্তে-রাঙানো দানের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি। শহীদ-স্মৃতি অমর হোক। জয়যুক্ত হোক আমাদের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা।’ সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলেন,‘ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংস্কৃতিক সমপ্রীতির জন্য রবীন্দ্র-নামাঙ্কিত এই পুরস্কার ছায়ানটকে প্রদান করে আমাদের কৃতজ্ঞতাবদ্ধ করেছেন। আপন সংস্কৃতির প্রসার ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলায় নবপ্রেরণা যুগিয়েছেন।’
বাংলাদেশের অহংকার তিনি। শুধুই কী বাংলাদেশের? প্রতিটি বাঙালিরও কী নয়? বাঙালিত্বের বোধকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার, আপন সংস্কৃতির শক্তিতে বিকশিত করার প্রেরণা যুগিয়ে চলেছেন সারা জীবন ধরে। তাঁর চলায়,বলায়- অশিক্ষা, কূপমণ্ডূকতা দূর করে মানুষের মনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাতিঘর জ্বালাতে নিরন্তর সাধনা করেছেন। সনজীদা খাতুন নিরন্তর সাধনা আর লক্ষ্যে অবিচল থেকে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম এই পথপ্রদর্শক শক্ত হাতে হাল ধরে ছায়ানটকে নিয়ে এসেছেন এক অনুকরণীয় অবস্থানে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছায়ানটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংগঠনিক দক্ষতার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছেন দৃষ্টান্ত, পরিণত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্বে।
আমাদের উজ্জ্বল নক্ষত্র সনজীদা খাতুন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বহুমাত্রিক প্রতিভা এবং বহুমাত্রিক পরিচয়ে পরিচিত সনজীদা খাতুন একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ এবং শিক্ষক। ছায়ানটের প্রাণপ্রিয় এই মানুষটির ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং মা সাজেদা খাতুন। তাঁর স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ ওয়াহিদুল হক। এ দম্পতির তিন সন্তান, এক পুত্র ও দুই কন্যা। বাবা উপমহাদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক, জাতীয় অধ্যাপক, জ্ঞানতাপস প্রজ্ঞার প্রতীক পুরুষ ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সংসারে চার পুত্র ও সাত কন্যার একজন সনজীদা খাতুন। বাবা ড. কাজী মোতাহার হোসেন সারাজীবন ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা,পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে লড়েছেন। তাঁরই আদর্শ লালন করে লড়াই চালিয়েছেন সনজীদা খাতুন। বাবার দেখানো পথেই তিনি জ্ঞানের চর্চা করেছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম সংগঠন ‘ছায়ানট’। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করা ছাড়াও এই সংগঠন বাদ্যযন্ত্র, সংগীত, নৃত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনা করে। পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ রমনার বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পর একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন কয়েকজন সংগঠক। ১৯৬১ সালে সুফিয়া কামালকে সভাপতি আর ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে ছায়ানটের প্রথম কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সদস্য ছিলেন সনজীদা খাতুন।
১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্সে 'নজরুল স্বর্ণপদক' অর্জন করেন। ১৯৫৫ সালে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে এমএ-তে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৮ সালে শান্তিনিকেতন থেকে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ' গবেষণাপত্রে পিএইচডি করেন। পিএইচডি-উত্তর গবেষণা 'ধ্বনি থেকে কবিতা'। ১৯৫৭ সাল থেকে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা। ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসরগ্রহণ। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পুনর্নিয়োগ ক্রমে অধ্যাপনা। তাঁর অসামান্য কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সনজীদা খাতুন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, কলকাতার ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট' থেকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি, বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্টের স্বর্ণপদক ও সম্মাননা, ‘সা'দত আলী আখন্দ পুরস্কার', ‘বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার', ‘অনন্যা’ পুরস্কার, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানজনক ফেলোশিপ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশিকোত্তম উপাধি, বিজয় দিবস পদক ও বাংলা একাডেমীর রবীন্দ্র-পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৫৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার এবং ১৯৬৪ থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত সঙ্গীতশিল্পী তিনি। বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন বের হয়েছে তার। এর মধ্যে রয়েছে 'গানের ভিতর দিয়ে' শিরোনামে কলকাতার 'শামিল' বিদ্যালয় ভবনে প্রশিক্ষণ দেওয়া রবীন্দ্রনাথের গান এবং গান নিয়ে আলাপ-আলোচনার তিনটি সিডির সংকলন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতগুলো হলো, ‘আবার আসি ফিরে',‘করুণাধারায় এসো' এবং ‘ছুটির বাঁশি বাজল’ অন্যতম। ১৯৮১ সালে বের হয় রবীন্দ্রনাথের গানের লং প্লে 'অতল জলের আহ্বান'। ১৯৬১ সালে জন্ম থেকে ছায়ানট সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত তিনি। ১৯৭২ সাল থেকে ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের অবৈতনিক অধ্যক্ষ। ২০০১ সাল থেকে ছায়ানটের সভাপতি। তাছাড়া তিনি একাধারে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নালন্দা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশে ব্রতচারী আন্দোলনের নবযাত্রায় ব্রতচারী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সন্জীদা খাতুনের গবেষণা, সাহিত্য সমালোচনা, সমাজ-সংস্কৃতি, আত্মজীবনী মিলিয়ে ৪০টির বেশি লেখা বই, তাঁর গাওয়া গান বা সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ দেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক ধারাকে প্রভাবিত ও শক্তিশালী করেছে। সে জন্য আমরা, আমাদের প্রজন্ম এবং আমাদের পরের প্রজন্ম তাঁর কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতের বাংলাদেশও কৃতজ্ঞ থাকবে সন্জীদা খাতুনের কাছে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ হলো- ‘কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত', ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’,‘অতীত দিনের স্মৃতি',‘তোমারি ঝরণাতলার নির্জনে’,‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’,‘কাজী মোতাহার হোসেন’,‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, 'বাংলাদেশের সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই', 'ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা' অন্যতম। সম্পাদনা করেছেন ‘স্মরণ',‘মুক্ত করো হে বন্ধ',‘গল্প সংগ্রহ',‘জগতে আনন্দযজ্ঞে',‘উদ্গম',‘প্রবন্ধ সংগ্রহ',‘গীতবিতান : তথ্য ও ভাবসন্ধান',‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ ত্রৈমাসিক পত্রিকা।
২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের সম্মানসূচক ‘টেগোর অ্যাওয়ার্ড ফর কালচারাল হারমোনি’ সম্মাননা গ্রহণ করেন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন। আলাপকালে তিনি বলেন,এটা খুব সম্মানজনক পুরস্কার। ছায়ানটের কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ প্রাপ্তি ছায়ানটের একার নয়, সবার। যে কাজের স্বীকৃতি আমরা পেলাম এটা পাওয়ার আশায় আমরা কিছু করিনি। কাজ করতে চেয়েছি বলে করেছি। তাই কোনো প্রাপ্তিতেই আমরা উচ্ছ্বসিত নই। তবে প্রেরণা পেয়েছি এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে, যা সামনে পথচলার শক্তি জোগাবে আমাদের। রবীন্দ্রনাথকে সংগ্রামের সাথী হিসেবে উল্লেখ করে সন্জীদা খাতুন বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির এক মহান আদর্শ। ‘শুধু বাঙালি হলে হয় না, হতে হবে বিশ্ব নাগরিক'- রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাকে আমাদের কাছে আদর্শ বলে মনে হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রাণের মানুষ, সেই রবীন্দ্রনাথেরই সংগীত ‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে’… সনজীদা খাতুনের বেলায় এ কথা ভীষণ সত্য। অত্যন্ত সফল একজন মানুষ তিনি। অন্যায় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে করেছেন সংগ্রাম। সুন্দরকে বুকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। জীবনের একেবারে শুরু থেকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রগতির পথ। সারা জীবন এই পথে হেঁটে মুক্তির সন্ধান করেছেন। তাঁর দেখানো পথ ধরে চলেছে অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী। বাঙালিত্বের বোধ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সারাজীবন কাজ করেছেন অক্লান্তভাবে নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচল থেকে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির আলোয় পৃথিবীর মুখ দেখার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছেন। কবিগুরুর গানের বরেণ্য শিল্পী ও গবেষক সংগঠক হিসেবে পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য।
ছায়ানটের ক্লাসে সনজীদা আপার সরাসরি ছাত্র হওয়ার পরম সৌভাগ্য আমার হয়েছে। প্রবল আশাবাদী মানুষ আপা বিভিন্ন সময়ে ক্লাসের আলোচনায় যেমন প্রাণবন্ত তেমনি আলোকিত হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রআলোচনায়। তিনি বলেছেন অনেক কথা, সে সব নোট করা আছে, কিছু বাণীবদ্ধ করেও রেখেছি। তিনি যেমন আলোচনাকালে নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এ পর্যন্ত আমার জীবনে আমি যা দেখলাম, অনেক চলে এসেছি না আমরা! অনেক কিছু করতে পেরেছি। এবং আরও করে যাব। আমাদের সময় আসবে। আমরা তো কোন চটুল লঘু বিষয়ের চর্চা করছি না। আমরা বাঙালির একেবারে নিহিত যে ভাবটা, যে সৌন্দর্যটা সেটার চর্চা করছি। তাই আমার কোন হতাশা নেই। হতাশার কোন কারণই আমি দেখি না। অনেক রকমের মানুষ দেশে বাস করে। এটা বুঝতে হবে। কাজেই আমরা হেরে যাইনি। শেষ পর্যন্ত হেরে যাব না।’ আপা বলেছিলেন, ‘যখন দেখি চারদিকে বিশৃংখলা, ধর্ম নিয়ে হীনতা। যখন দেখি মানুষ মানুষকে সম্মান দেয় না। ধর্মের নামে মনুষত্বের অপমান করা হয়-তখন খুব কষ্ট পাই। সমাজ থেকে এসব দূর করতে হলে মন থেকে সৎ হবার চেষ্টা চাই সবার মাঝে।' আপা সবসময় বলেন, ‘চাই শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির মেলবন্ধন।’ পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রে যে বিভেদ ছিল সেই বিভেদ আজো কাটেনি। অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও সেই বিভেদ কাটাতে ব্যর্থ হলাম আমরা। এ বিষয়ে সনজীদা আপা বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে প্রশ্রয় দেয়া শুরু হয়েছিল সেই পাকিস্তানি আমল থেকেই। বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক ও মৌলবাদী সমর্থনপুষ্ট সরকারগুলো সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। এটা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে জাতি ও রাষ্ট্রের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির জন্য। বাঙালি মানে হিন্দু এই ধারণা রাজনৈতিক উদ্দেশে ছড়ানো হয়েছে। তার প্রভাব জাতির মাঝে আজো রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে চিরায়ত বাংলার ইতিহাস বর্ণণার চাইতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা ইতিহাসকে আমাদের বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু কষ্টের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও এসব সংশোধনের উদ্যোগ নেই। তারা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার মাঝ থেকে এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব দুর করা না গেলে তা থেকেই যাবে। এটা কিন্তু মৌলবাদী মতাদর্শের দলগুলো ভালো বোঝে। তাই তারা শিক্ষাকে বেছে নিয়েছে। সে কারণে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি আরো জেঁকে বসেছে।’
এক সাক্ষাৎকারে সনজীদা আপা অকপটে বলেছিলেন কিছু কথা, ‘ছায়ানট আমার জীবন। এই নাম, এই ছায়ানটা নিয়ে আমাকে কী যে ভুগতে হয়েছে! ছায়ানটের সঙ্গে আছি বলেই হুট করে আমাকে ঢাকা থেকে বদলি করে দেয়া হলো রংপুরে। আমি তখন কীভাবে যে কী করি, কীভাবে ঢাকায় ফিরে আসি, অস্থির হয়ে পড়লাম ছেলেমেয়েদের জন্য। তিনটা বচ্চাকে ঢাকায় রেখে গেছি। ছোটাটির বয়স তখন দশ। বদলির জন্য তখন এমনকি খন্দকার মোশতাকের কাছেও গিয়েছিলাম। সে ছিল আমার সেজো দুলাভাইয়ের ছোট ভাই। তার কাছে গিয়ে যখন বললাম, শুনেই সে বলল, ছায়ানট নামটাই তো রহস্যজনক; ছায়া। তারপর সে আমাকে আমাদের একটা কার্ড দেখিয়ে বলল, এখানে রবীন্দ্রনাথের যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, তার দুটো চোখ তো দু'দিকে- পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ববঙ্গকে এক করতে চায়। দু'দিকেই চোখ রেখেছে। এই ব্যাখা নাকি আর্মি থেকে হয়েছে। সে আমাকে কোনোই সাহায্য করল না। আত্মীয় বলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সে যে কত পাজি, সেটা পরে বুঝেছিলাম; আগে বুঝিনি। যা হোক, এ বদলির ব্যাপারটা ছায়ানট হয়ে যাওয়ার পরের ঘটনা। নামের প্রসঙ্গ ওঠায় এটা আগে চলে এলো।’ ছায়ানটের বেশ কিছু নতুন কার্যক্রম হাতে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আপা বলেন, ‘এই যে ছায়ানট, এটা কিন্তু আমাদের নিজেদের নয়। এটা মানুষের। সাধারন মানুষের রক্তে এটা গড়ে উঠেছে। আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝেছি সবার আগে শিক্ষা। তার সঙ্গে সঙস্কৃতির যোগ থাকা চাই। সেই লক্ষ্যেই ছায়ানট শুধু সঙ্গীত শিক্ষা ও তার প্রসারেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যায়তন 'নালন্দা'। ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম ভাষার আলাপ, শিশুদের জন্য 'শিকড়'। এসব নানা কর্মকা্লের মধ্য দিয়ে আমাদের লক্ষ্যটা হচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতির শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিশ্বমানব হয়ে ওঠা।' আর যে লক্ষ্যে এসব কার্যক্রম শুরু করলেন সে সব কাজে তাঁর উপলব্ধি হলো, ‘আমি চাইলেই তো সবকিছু হয়ে যায় না। তাকে পূর্ণতা দিতে হলে নিরন্তর চেষ্টা প্রয়োজন। সে চেষ্টা শুধু নিজের উদ্যোগকে সফল করার জন্য নয় বরং তা পরিবেশ, সমাজ ও দেশের জন্য। যখন দেখি চারদিকে বিশৃংখলা, ধর্ম নিয়ে হীনতা। যখন দেখি মানুষ মানুষকে সম্মান দেয় না। ধর্মের নামে মনুষত্বের অপমান করা হয়— তখন খুব কষ্ট পাই। সমাজ থেকে এসব দূর করতে হলে মন থেকে সত্ হবার চেষ্টা চাই সবার মাঝে। আমরা ছায়ানট, নালন্দা, শিকড়- এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তা করার চেষ্টা করছি। এই চেষ্টা সকল শুভবুদ্ধি মানুষের মধ্যে থাকলে তবেই একদিন আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।’
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও সনজীদা আপা সরাসরি ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নানা উদ্দীপক গানের সঙ্গে প্রচারিত হয় রবীন্দ্রনাথের গান৷ সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক এঁদের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে গানের দল৷ তাঁরা ঘুরে বেড়ান মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে৷ সে সময়কার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছেন, ‘আমাদেরকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল কলকাতায়৷ সেখানে গিয়ে আমরা ‘রূপান্তরের গান' নামে একটি গীতি আলেখ্য তৈরি করেছিলাম৷ তাতে ‘সার্থক জনম আমার' ছিল৷ ‘সোনার বাংলা' তো ছিলই৷ আরো গান ছিল৷ ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে, নগরে প্রান্তরে বনে বনে৷ অশ্রু ঝরে দু নয়নে,পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে।’ কিংবা আরেকটা গান ছিল-‘ঢাকোরে মুখ চন্দ্রমা, জলদে’৷ মানে চাঁদকে বলা হচ্ছে মুখ ঢেকে ফেলো, বড় লজ্জার দিন, বড় কষ্টের দিন, দুঃখের দিন। এই গানগুলোকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করে তখন গাইতাম। এবং এই গান হতো মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে,শরণার্থীদের শিবিরে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে সাধারণ মানুষকে আমাদের বেদনার সাথে যুক্ত করবার জন্য আমরা এই গানগুলো গাইতাম৷ কাজেই রবীন্দ্র সংগীত আমাদের আন্দোলনের মস্তবড় একটা হাতিয়ার ছিল এবং এখনও আছে৷ এখনও আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি৷মুক্তিযুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথের গান এভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
গানের মানুষ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে রবীন্দ্রনাথের গানে সমর্পিত ব্যক্তিসত্তা সনজীদা খাতুন জীবনে কখনোই টাকার পেছনে ছোটেননি। নিজের কাজকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এভাবে সংগঠনের কাজে নিজের জীবনকে সমর্পণ করে দেয়া, কোনো ব্যক্তিগত প্রত্যাশার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের জন্য এমন সম্পূর্ণরূপে নিবেদন এসময় তেমন দেখা যায় না। ছায়ানটের জন্য কাজ করতে গিয়ে প্রাপ্তির কথাও ভাবেননি। পুরো জীবন মানুষের জন্য সমর্পিত তার। তাঁর সারাজীবনের পথচলা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হয়ে রয়েছে। তাঁর চলায়, বলায়- অশিক্ষা, কূপমণ্ডুকতা দূর করে মানুষের মনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাতিঘর জ্বালাতে নিরন্তর সাধনা করেছেন।
সঙ্গীতে সমর্পিত এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ছায়ানটের সভাপতি অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন। সুরকে আশ্রয় করেই ঋদ্ধ হয়েছে তাঁর দীর্ঘ মননশীল জীবনচক্র। সঙ্গীতকে হাতিয়ার করে চালিয়ে গেছেন সমাজ বদলের লড়াই। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকায় যে সাহসী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা ঘটেছিল, ষাটের দশকজুড়ে সেটাই বহুবিস্তৃত হয়ে দেশে অবিশ্বাস্য এক গণজাগরণ সৃষ্টি করে। সেই শক্তিশালী আন্দোলনের পেছনে ছিল দেশের জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সে সময়ের প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলোর যৌথ ভূমিকা। ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পথে দেশের মানুষকে প্রস্তুত করে তুলতে সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিপুলভাবে সহায়তা করেছিল। এই সবকিছুর মধ্যে বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অর্জনের অব্যাহত সংগ্রামের গভীর আরেকটি স্রোতোধারাও সে সময় প্রবাহিত ছিল। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা রবীন্দ্রচর্চার বিরুদ্ধে পরোক্ষ নির্দেশ জারি করে। সে নির্দেশ অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বাঙালি সংস্কৃতির সংগ্রাম। রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান হয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে বড় একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। দেশের সেরা শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাতে অংশ নেন। অনুষ্ঠান পালনের পরপর সংগঠক ও শিল্পীরা একসঙ্গে কাজ করার জন্য নতুন একটি সংগঠন তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। নবগঠিত সেই কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকেই সংগঠনের নাম ঠিক হয় ‘ছায়ানট’। শুরু থেকেই এ সংগঠনের সামনে ছিলেন সন্জীদা খাতুন।
সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উত্থান-পতনময় ইতিহাসে সব প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন সন্জীদা খাতুন। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ও ওয়াহিদুল হকদের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘রূপান্তরের গান’–এর দল। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থীশিবিরসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। রবীন্দ্রসংগীত ছিল তাঁদের আন্দোলনের মস্ত হাতিয়ার। সন্জীদা খাতুনের ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’ এই এগিয়ে যাওয়ার পথে সন্জীদা খাতুনের প্রধান বাহন ছায়ানট। অব্যাহত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনন্য এই সংগঠন কালক্রমে হয়ে ওঠে বাঙালি সংস্কৃতি ও মানবিকতা চর্চারও একটি কেন্দ্র। এখনো আমাদের সবাইকে সঞ্জীবিত করে চলেছে ছায়ানট। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবিক বাংলাদেশ গঠনের কাজে পালন করছে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। ষাট দশকের বেশি সময় ধরে সামনে থেকে দৃঢ়ভাবে এর নেতৃত্ব দিয়েছেন সন্জীদা খাতুন। গান ছাড়া বিষয়ে তিনি বলেছিলেন,তিনি গান ছাড়তে পারবেন না। আত্মজীবনী সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দেতে তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমার আসল কাজের ক্ষেত্র। বিশেষ করে, বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণ আমার উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র।’
ছায়ানটে সনজীদা আপার কন্ঠেই শোনা, তাঁরই প্রিয় কবি নজরুলের একটি কবিতা, কবিতাটিতে ধমার্ন্ধদের প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাব-ভাষ্য খুঁজে পাওয়া যায় এবং সমকালের প্রেক্ষিতেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেদিনের সেই ‘ক্ষমা করো হযরত’ কবিতাটির পাঠ আজ খুব মনে পড়ছে।–
তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত।
মোরা ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমারি দেখানো পথ॥
বিলাস-বিভব দলিয়াছ পায় ধূলি সম তুমি, প্রভু,
তুমি চাহ নাই আমরা হইব বাদশা-নবাব কভু।
এই ধরণীর ধন-সম্ভার — সকলেরি তাহে সম অধিকার;
তুমি বলেছিলে ধরণীতে সবে সমান পুত্র-বৎ॥
প্রভু তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি ক'রে
আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।
ভিন্ ধর্মীর পূজা-মন্দির, ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর,
প্রভু আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনে'ক পর-মত॥
তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি,
তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী।
মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা
সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা,
বেহেশ্ত্ হ'তে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত॥
(তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/আবদুল্লাহ আল মোহন/এমই