ইসলামের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় হলো মক্কার মুশরিকদের ইব্রাহীম আ: এর ধর্মের বিকৃতি। কালের প্রবাহে সেই পবিত্র ধর্মকে নিজেদের প্রবৃত্তির কাছে ও শয়তান নির্দেশিত পথের কাছে বিকিয়ে দেয়। তারা মুখে স্বীকার করত যে, আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা ও মহাশক্তিমান, কিন্তু পাশাপাশি বিভিন্ন দেবদেবী, ফেরেশতা ও পয়গম্বরদের মূর্তি বানিয়ে সেগুলোর উপাসনা করত।
বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাস করত:
তারা তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করতো। কোনো কাজ করবে কি করবে না, তা জানতে তারা বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করত। চাঁদ ও তারার অবস্থান দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করতো। তারা বিশ্বাস করত, কোনো কাজের সফলতা বা ব্যর্থতা তারার অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। অমঙ্গলজনক সময় ও স্থান নির্ধারণ মেনে চলতো তারা বিশ্বাস করত, কিছু নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে কাজ করলে তা ব্যর্থ হবে।
কন্য সন্তান কে জীবন্ত পুতে ফেলতো:
কুরাইশরা কন্যাসন্তানকে অপমানজনক মনে করত এবং অনেক সময় জীবন্ত কবর দিত। তারা নারীদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করত এবং বহুবিবাহ ও নারী শোষণের বিভিন্ন অনৈতিক প্রথা চালু করেছিল। আল্লাহ এসম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেন, "যখন তাদের কেউ কন্যাসন্তানের সুসংবাদ পায়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় এবং সে ক্রোধ চেপে রাখে।" (সূরা আন-নাহল, ১৬:৫৮)
কাবায় মূর্তি স্থাপন:
শুধু তাই নয়, তারা একপর্যায়ে কাবা ঘর, যা একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মিত, সেখানে বিভিন্ন নবী, রাসুল, পয়গম্বর, লাত, উজ্জা ও মানাত এর প্রতিকৃতির ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করেছিল।এদেরকে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও সুপারিশ কারী মেনে প্রতিনিয়ত উপাসনা করতো।
ইবাদতের নামে বিভ্রান্তি ও বিকৃতি:
মক্কার মুশরিকরা ইবাদতের অনেক পরিচিত রীতিনীতি পালন করত—নামাজ, হজ্ব, রোজা, তাওয়াফ—কিন্তু সবই ছিল বিকৃত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারা কাবা ঘরের তাওয়াফ করত উলঙ্গ অবস্থায়, যুক্তি ছিল—পাপপূর্ণ পোশাকে আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করা চলবে না! এই কাজের বিরুদ্ধে আল্লাহ তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন: "হে আদম সন্তানেরা! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় পবিত্র পোশাক পরিধান করো।" (সূরা আল-আ'রাফ, ৭:৩১)
রোজা ও হজ্বের বিকৃতি:
তারা হজ্বে গিয়ে আল্লাহর পরিবর্তে নিজেদের তৈরি দেব-দেবীদের নামে তকবির দিত, কুরবানির পশুর রক্ত মূর্তির গায়ে লেপন করত। এমনকি রোজার মাধ্যমেও নিজেদের ইচ্ছেমতো নিয়ম চালু করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, তাদের ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছিল না, বরং তা নিজেদের কল্পিত বিশ্বাসের ভিত্তিতে, এক ভ্রান্ত ও শয়তান প্রদর্শিত আনুষ্ঠানিকতা ছিলো মাত্র।
মুক্তিদাতা বা ভাগ্যদাতা হিসেবে তাবিজ-কবজের ব্যবহার:
মক্কার মুশরিকরা বিভিন্ন অলৌকিক বিশ্বাসে নিমগ্ন ছিল। তাবিজ, কবজ, আংটি, ব্রেসলেট ইত্যাদি তারা সৌভাগ্য ও বিপদ-মুক্তির জন্য ব্যবহার করত। অথচ নবী করিম (সা.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোনো তাবিজ ঝুলিয়ে রাখে, সে শিরক করল।” (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস ১৭৪২২)। অথচ মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন: “নিশ্চয়ই, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে শিরক করে; কিন্তু যাকে ইচ্ছা, তিনি অন্য সব গুনাহ ক্ষমা করেন।” (সূরা আন-নিসা, ৪:১১৬)।
মাযার ও কবর পূজা:
মক্কার লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের কবরকে পবিত্র মনে করত এবং সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করত। তারা বিশ্বাস করত, মৃত ব্যক্তির আত্মা জীবিতদের সাহায্য করতে পারে এবং তাদের সমস্যা দূর করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “তোমরা কবরস্থানে গিয়ে সিজদা করো না, কারণ এটি শিরকের কাজ।” (মুসলিম, ৯৭২)।
নিকা-উল বদল" (স্ত্রী বদল):
বহুবিবাহকে কুরাইশরা কেবলমাত্র পুরুষদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করত। কোনো পুরুষ মারা গেলে তার স্ত্রীকে তার সম্পত্তির অংশ হিসেবে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। তারা “নিকা-উল বদল” (স্ত্রী বদল) প্রথা চালু করেছিল, যেখানে একে অপরের স্ত্রীদের বিনিময় করতী। আল্লাহ ঘোষণা দেন, “তোমরা নারীদের প্রতি সুবিচার করো এবং তাদেরকে উত্তরাধিকার হিসেবে গ্রহণ কোরো না।” (সূরা আন-নিসা, ৪:১৯)।
গনকের প্রতি বিশ্বাস: তারা গনকদের বিশ্বাস করতো। তাদেরকে ভবিষ্যত বক্তা হিসেবে মানতো। রাসুল বলেন, “যে ব্যক্তি গণকের কাছে গিয়ে বিশ্বাস করল, সে মুহাম্মদের ওপর অবতীর্ণ ধর্মকে অস্বীকার করল।” (আবু দাউদ, ৩৯০৪)।
স্বপ্ন ব্যাখ্যার নামে প্রতারণা:
কুরাইশদের মধ্যে কিছু লোক নিজেদের স্বপ্নব্যাখ্যাকারী হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা স্বপ্নের ভিত্তিতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করত এবং অনেক সময় লোকদের ভুল দিকনির্দেশনা দিত। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই বানিয়ে বানিয়ে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করত, যা ছিল একধরনের প্রতারণা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি তার নিজের বানানো স্বপ্নকে সত্য বলে প্রচার করে, সে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি পাবে।” (বুখারি, ৭০৪২)
মনগড়া হালাল হারাম নির্ধারণ:
মুশরিকরারা “বাহীরা”, “সায়েবা”, “ওসীলা” ও “হাম” নামক কিছু পশু তাদের মিথ্যা ধর্মীয় রীতির কারণে খাওয়া নিষিদ্ধ করেছিল। আল্লাহ বলেন: "আল্লাহ কোনো বাহীরা, সায়েবা, ওসীলা বা হাম নির্ধারণ করেননি, বরং কাফেররাই এসব মিথ্যা রীতি তৈরি করেছে।" (সূরা আল-মায়িদা, ৫:১০৩)
পরিশেষে, ইসলাম মানুষের হৃদয় ও বিশ্বাসকে একমাত্র আল্লাহর প্রতি কেন্দ্রীভূত করতে চায়। বিপদ-আপদ, রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট—সবকিছুতেই একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করতে শেখায়৷ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: "যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো বিপদে ফেলেন, তবে তিনিই তা দূর করতে পারেন।" (সূরা আল-আনআম, ৬:১৭)।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, সিলেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
আমার বার্তা/জেএইচ