পতিত সরকারের দোসর সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান চাকরি কালীন সময়ে দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন। শত অভিযোগে অভিযুক্ত দুর্নীতির শীর্ষে থাকা নুরুজ্জামান টাকার বিনিময়ে তদবির করে সব আমলনামা ধামাচাপা দিয়ে আয়েশি জীবন যাপন করছেন। দুর্ধর্ষ এই ভ্যাট কর্মকর্তা দুদকের ফাইল পর্যন্ত গায়েব করে ফেলেছেন। তবে দুদক সূত্র বলছে, হাজার কোটি টাকার মালিক নুরুজ্জামান তার অবৈধ আয়ের অধিকাংশ টাকা পাচার করেছেন দেশের বাইরে। চাকরি জীবনে গণভবনের সিন্ডিকেট মেইনটেইন করে পোস্টিং নিতেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। নুরুজ্জামানের ঘুষের মাত্রা ছিলো বড়ো ধরনের। অর্থাৎ মোটা দাগের টাকা ঘুষ বাণিজ্য ছিলো তার নেশা। ছোট খাটো কোন টাকা তিনি ধরতেননা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতা আন্দোলন ঠেকাতে সরকারের পক্ষে নগদ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে সাবেক ভ্যাট কমিশনার নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে।
ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানাধীন শৈলঢুবি গ্রামে নূরুজ্জামানের বাড়ি হলেও তিনি পরিচয় ব্যবহার করতেন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা। কথায় কথায় নাম বিক্রি করতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাছাড়া সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ এর নামও ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি সর্বমহলে এবং ডিভিশনে ক্ষমতাধর একজন ভ্যাট কমিশনার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার অধিনস্থ ও সমসাময়িক এবং ঊর্ধ্বতন স্যারদের কাছে ছিলেন শেখ পরিবারের স্বজন হিসেবে পরিচিত। অসাধ্যকে সাধ্য করার ক্ষমতা এবং ম্যানেজ মাস্টার হিসেবে পরিচিত লাভ করে ছিলেন একেএম নুরুজ্জামান। বিশেষ করে গণভবনের নাম ব্যবহার করে বাগিয়ে নিতেন সব তদবির বাণিজ্য। ক্ষমতাধর নুরুজ্জামান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দপ্তরের একজন উপদেষ্টা এবং সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী প্রয়াত সাজেদা চৌধুরীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে মামলা সহ বিভিন্ন তদবিরের সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নুরুজ্জামান ২০০৯ সালে কাস্টমস সাউথে থাকা অবস্থায় দেদারসে চাকরি দিয়েছেন এলাকাবাসী এবং আত্নীয় স্বজনদের। ওই সময় নিয়োগে অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির বিষয় টি নিয়ে আলোচনায় আসেন নুরুজ্জামান। সবার কাছে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন। ২০১৩ সালে কমলাপুর আইসিটিতে নিয়োগ বাণিজ্য এবং ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন নুরুজ্জামান। গোপালগঞ্জের দোহাই দিয়ে কোনমতে ওই যাত্রায় বিপদ সামলান। কিন্তু ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়নি চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত।
একটি মামলার নথিপত্র পুড়ে অভিযোগে জানা যায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কয়েকটি স্থলবন্দর থেকে রাজধানীর ইসলামপুর ও নয়াবাজার পর্যন্ত গড়ে ওঠা চোরাই পণ্যের কারবারি সিন্ডিকেটকে অনেক বছর আগ থেকে সহায়তা দিতেন সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান। রাজস্ব বিভাগের বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক গোয়েন্দা এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে আসে এ তথ্য। কিন্তু ওই সময়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দেন।
২০১৭ সালের ২০ আগস্ট পুরান ঢাকার গুলশান আরা সিটি মার্কেটের সামনে কাভার্ড ভ্যান থেকে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মাসটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সৈয়দ আবিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ও খন্দকার সুরাত আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। মামলার তদন্ত করে সিআইডি। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শতকোটি টাকারও বেশি শুল্ক ফাঁকির তথ্য মেলে।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের মাসুদ প্যাকেজিং, মেসার্স ইসলাম অ্যাসোসিয়েটসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া নথি তৈরি করে ডুপ্লেক্স বোর্ড কাগজ আমদানি করে চোরাকারবারির অভিযোগে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আদমজী ইপিজেড কেন্দ্রিক মেসার্স আঙ্কেল প্যাকেজিং লিমিটেড এর নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে মামলা করা হয়। এসব মামলা সিআইডি তদন্ত করে তথ্য পায় ব্যাংকের সঙ্গে আঁতাত করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে ভুয়া প্রতিষ্ঠান বন্ড জালিয়াতির।
চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিজানুর রহমান দীপু চাকলাদার ও হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার নামের দুই সহোদরের শুল্ক ফাঁকি ও চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরপর দীপুকে গ্রেফতার করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। অপুর মালিকানাধীন মেসার্স চাকলাদার সার্ভিস এবং দীপুর মালিকানাধীন এমআর ট্রেডিংয়ের সঙ্গে কাস্টমস কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান এর সখ্যতা থাকায় সার্বিক সহযোগিতা করেন তিনি।
ওই মামলায় দীপু ছাড়াও চারজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁরা হলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী সোহরাব হোসেন ওরফে রিপন, ডেসপাচ শাখার কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম, এআইআর শাখার উচ্চমান সহকারী মাসুম ও মফিজুল ইসলাম লিটন নামের এক আমদানিকারক। মফিজুল ইসলাম লিটন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। লিটন অপু-দীপুর চোরাকারবার ও শুল্ক ফাঁকি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। লিটন তার জবানবন্দিতে উক্ত সিন্ডিকেটের সহায়তাকারী শেল্টারদাতা হিসেবে একেএম নুরুজ্জামানের নাম প্রকাশ করেন। কিন্তু নুরুজ্জামান থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। নূরুজ্জামান ছিলেন চোরাকারবারিদের শেল্টার দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তার এই অবৈধ টাকা পাচার করেছেন লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ার। নুরুজ্জামান একাধিক মামলার আসামি হয়েও টাকা জোরে তাকে জেল হাজতে যেতে হয়নি। কারণ তিনি ম্যানেজ করার সব বিষয়ে পারদর্শী।
অভিযোগে আরো জানা যায়, সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান ২০১১ সালে ঢাকা পূর্বে বন্ড কমিশন থাকা অবস্থায় দেদারসে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমস এ কর্মরত অবস্থায় বেহিসেবি অবৈধ টাকা কামিয়েছেন। চট্রগ্রাম থাকাকালীন সময়ে কয়েকশ' কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ জানা গেছে। ২০২২ সালে ঢাকা পান গাও সিগারেট ও মদ কন্টিনার গায়েবের মামলায় আসামি হন সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান। মামলা টি মহামান্য হাইকোর্ট এ চলমান রয়েছে। ওই মামলার বাদি সিএন্ডডেপ কমাকেশন এমদাদ। মামলা থেকে রেহাই পেতে গণভবনে গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব তহবিলে জমা দিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গায়ে কাদামাখানো এই কর্মকর্তা নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে মামলা থেকে বাচার জন্য ছিলেন মরিয়া। এজন্য "তদবির বাজ নুরুজ্জামান"হিসেবে খ্যাত অর্জন করেছেন। নুরুজ্জামান চট্টগ্রামে পোস্টিং থাকা অবস্থায় বারশ' কন্টিনার চুরির সাথে জড়িতছিলেন। ওই মামলায় তার সাথে আরেক আসামি হলেন সিএন্ডডেপ মিজানুর রহমান। তিনি এম আর ট্রেডিং কোম্পানির মালিক। ওই ১২শ' কন্টিনারে ছিলো ফেব্রিকস (কাপড়) । ওই মামলাটি ধামাচাপা দিতে সাবেক আইনমন্ত্রীকে মোটা অংকের টাকা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন নুরুজ্জামান। মামলাটি চলমান রয়েছে।
নুরুজ্জামান-পাপিয়া দম্পতির এক ছেলে দাইয়ান ও এক মেয়ে নিশাত। মেয়ে নিশাতের দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে মেয়ে লন্ডনে বসবাস করেন। নুরুজ্জামানের অস্ট্রেলিয়াতে আলিশান বাড়ি, গাড়ি ও সম্পতি আছে বলে জানা গেছে। তিনি চাকরি থাকাকালীন সময়ে মেয়ে নিশাতকে নিয়ে ঘন ঘন অস্ট্রেলিয়া ও লন্ডন সহ বিভিন্ন দেশে যেতেন। যাওয়ার সময় মেয়ে নিশাত টাকা ডলার করে লাকেজে ভরে নিয়ে যেতেন। বাবার দাপট ও ক্ষমতার কারণে লাকেজ চেক করা হতোনা। গোয়েন্দা সংস্থা ও কাস্টম গোয়েন্দারা চেকের বদলে ডলার ভর্তি লাকেজ এগিয়ে দিতেন। এভাবে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন নুরুজ্জামান ও তার মেয়ে নিশাত। দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে বাড়ি বানিয়ে এবং ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগকারী একেএম নুরুজ্জামান রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
রাজধানীর অদুরে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় স্ত্রী পাপিয়ার নামে একটি গার্মেন্টস করেছেন নুরুজ্জামান। গার্মেন্টস টি পরিচালনা করেন চাচাত ভাই মহিউদ্দিন। এছাড়াও নামে বেনামে আরো ধন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন দুর্নীতি পরায়ণ সাবেক ভ্যাট কমিশনার নুরুজ্জামান। থাকেন ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাড়িতে। ওই বাড়ির সামনের বাড়িতে একটা ফ্ল্যাট আছে বলে জানা গেছে। সেখানে থাকেন শ্যালক হাবিবুর রহমান হেন্ডি।
অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য একেএম নুরুজ্জামানের মূঠো ফোনে একাধিক বার ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি। ওয়াটসআপে বার্তা পাঠিয়েও কোন উত্তর মিলেনি।
আমার বার্তা/এমই