যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, গত বছর আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর গতকাল তারা এক যৌথ বিবৃতি দেন। সেখানে তারা আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা আইওএম-এর চলতি বছরের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানকে সমর্থনের আহ্বান জানান। তারা মনে করেন, সবাই এগিয়ে না এলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য, বাসস্থান ও সুরক্ষার সংকট তৈরি হবে।
জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চাহিদার তুলনায় ৩০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কম অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আর এই তহবিল কমার কারণে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, রেশন কমানো হয়েছে, যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
পাঁচটি দেশের প্রতিনিধি দল ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের সুরক্ষা এবং সমর্থনের আহ্বান জানানো জরুরি মনে করছি। আমরা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় দেখেছি, তাদের মানবিক সম্পদ কমে যাচ্ছে। এবং আগুন ও সামনে বর্ষাকালে খারাপ আবহাওয়ার কারণে কমপক্ষে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন।’
এভাবে সহায়তা কমতে থাকলে কমপক্ষে দেড় লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী খাদ্য, নিরাপদ পানীয় জল, বাসস্থান, সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবাসহ প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো পাবে না। জ্বালানি তেল ও গ্যাস (এলপিজি)-র অভাবে এক লাখ পরিবার জ্বালানির জন্য কাঠের ওপর নির্ভরশীল হবে। তাদের মাসে ১৪ হাজার টন জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে হবে। ফলে বন উজাড় হবে এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, ‘আমরা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই কাজ করতে পারি এবং করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং সংলগ্ন এলাকার তিন লাখ ৪৬ হাজার বাংলাদেশিকে তাদের জীবন রক্ষায় সহায়তা অব্যাহত আছে। কিন্তু সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তাদের আত্মনির্ভরশীলতা, জীবিকার সুযোগ তৈরি করা জরুরি।’
রোহিঙ্গাদের জন্য আরো মানবিক ও টেকসই সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স পরিকল্পনাকে সমর্থন জানাতে হবে। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ ১.৩৫ মিলিয়ন (সাড়ে ১৩ লাখ) মানুষের জন্য ৮৫২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, প্রতি জনের জন্য ৬৩০ ডলার সংগ্রহ করা।
তারা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আমাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি। এই মানবিক কার্যক্রমে যারা সামনের সারিতে আছেন, তাদের প্রতিও আমাদের সমর্থন অব্যাহত আছে। আমরা অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকারকেও মানবিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই।’
তাদের কথা, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা এবং জীবন বাঁচাতে এই জরুরি সহায়তা খুবই প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমনের সাত বছর হয়েছে। সংকটময় এই সময়ে যখন তাদের রক্ষায় আরো সহায়তা প্রয়োজন, তখন নাটকীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা কমে গেছে। তাই সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
বিবৃতিতে জানানো হয় এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭.৬ মিলিয়ন ডলার অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে, জাপান দিয়েছে ২.৬ মিলিয়ন ডলার। নরওয়েও ৬.৫ মিলিয়ন ক্রোনার দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছে। সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানকে সমর্থন জানিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন।
তারা গত রোববার (১২ মে) দুপুরে উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
সংসদীয় কমিটির সদস্যরা জাতিসংঘের সংস্থা ডাব্লিউএফপি, আইএমওসহ বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম দেখেন এবং ক্যাম্প-৫-এর সিআইসি অফিসের কনফারেন্স রুমে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে তারা ঘুমধুমের নতুন ট্রানজিট ক্যাম্প, ১৮ নম্বর ক্যাম্পে রোহিঙ্গা কালচারাল মেমোরি সেন্টার, কুতুপালং সিআইসি অফিস পরিদর্শন করেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. এ কে আব্দুল মোমেন, কমিটির সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, নাহিম রাজ্জাক, নিজাম উদ্দিন জলিল, নুরুল ইসলাম নাহিদ, হাবিবুর রহমান ও সাইমুম সরওয়ার কমল, জারা জাবিন মাহমুদ।
কুতুপালং ক্যাম্পের আমীর হোসেন বলেন, ‘আগে রেশনের জন্য আমাদের মাসে এক হাজার ২০০ টাকা দিতো। কয়েক মাস আগে কমিয়ে ৮৫০ টাকা দেয়া শুরু করে। এ মাসে আবার এক হাজার টাকা দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে আমরা কম দামে রেশন শপ থেকে খাদ্য কিনি। কিন্তু তাতে আমাদের হয় না। আমার পরিবারে ছয়জন সদস্য। অনেক কষ্ট হয়।’
‘রান্নার জন্য যে এলপি গ্যাস দেয় তাতে ১৫ দিনের বেশি চলে না। বাকি ১৫ দিন আমাদের ম্যানেজ করতে হয়। চিকিৎসা, ওষুধ এগুলোও পর্যাপ্ত নয়,’ বলেন তিনি।
তার কথা, ‘আমাদের বাইরে যাওয়া বা কাজ করার কোনো সুযোগ নাই। যারা ভিতরে এনজিওর সঙ্গে কাজ করেন তাদের কিছু বাড়তি আয় আছে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দাতাদের নজর এখন ইউরোপের শরণার্থীদের দিকে। এরপর এখন গাজা পরিস্থিতির কারণে সেখানেও নজর দিতে হচ্ছে দাতাদের। ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর নজর কমছে। সহায়তা কমছে।’
‘এই পাঁচ দেশের আহ্বানের কারণে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের আরো তৎপর হতে হবে। বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা না বাড়ায় তাহলে এটা বাংলাদেশের জন্যই আরো সমস্যা ডেকে আনবে,’ বলেন তিনি।
তার কথা, ‘ওখানে খাদ্য সংকট হলে নানা সমস্যা তৈরি হবে। ক্যাম্পে অপরাধ বেড়ে যাবে। তারা ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে তাদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করবে। তখন নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। চাপটা পড়বে বাংলাদেশের ওপরে।’
তিনি বলেন, ‘আমি জানি না ডোনাল্ড লুর এই সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু কতটা গুরুত্ব পেয়েছে। তবে বাংলাদেশের এটা শীর্ষে রাখা উচিত।’
আর সংসদীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘তাদের প্রতিমাসে ১০ ডলার করে সহায়তা দেয়ার কথা। এটা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। তাদের পাঁচজনের পরিবার হিসাব করে এই সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আসলে এই অর্থে তাদের ঠিক মতো চলে না। তাদের পুষ্টির হিসাব করে এটা দেয়া হয়।’ তার আশা, সহায়তা আরো বাড়বে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিনই নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সহায়তা না বাড়লে যে সমস্ত লোকজন সেখানে আছেন, তারা কষ্টের মুখে পড়বেন।’ তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়াই হচ্ছে আসল সমাধান। আমরা সেটা নিয়েও কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সে কথা বলেছি।’
আমার বার্তা/জেএইচ