কেউ কেউ থাকেন এই জনজাতির অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে আমরা চালাক-বোকা। কথাটি রহস্য করে বলা হলেও আমাদের জীবনের জন্য অপ্রিয় সত্য হলো এই চালাকির বোকামিতে পড়ে আমরা একে অন্যকে অবিরাম বিষ খাইয়ে চলেছি। দেশজুড়ে ভেজালের জাল যেভাবে বিস্তৃত, তাতে যে কোন প্রকারের খাদ্য,ফলমূল-শাক-সব্জি-মাছ কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতার নিজের সাবধানতা জরুরি। তবে অবিরাম এই অমনুষ্যোচিত অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতাও রয়েছে বাঙালির। ক্যালাস বা উদাসীন হবার কারণে বিষ খেয়েও কেউ কারো অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে তেমন একটা দেখা যায় না। সবাই যেন জেনে-শুনেই বিষ পান করে আত্মাহুতি দিয়ে যাচ্ছে। এ যেন ররি ঠাকুরের বিখ্যাত গানের বাস্তব রূপ-
‘আমি জেনে-শুনে বিষ করেছি পান,
প্রাণেরও আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।’
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে আমাদের খাদ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর ১৮ অনুচ্ছেদে পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্যের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় ৫৪ বছরেও খাদ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গ্রহণ করা যায়নি। সাউথ আফ্রিকা বা ইউক্রেনের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও তাদের জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। ভেজাল খাদ্যের আলোচনার শুরুতেই স্বীকার করতে হবে- নিরাপদ খাদ্য সবার জন্য জরুরি। যখন সবার খাদ্য প্রাপ্তিটাই একটা চ্যালেঞ্জ,সেখানে নিরাপদ খাদ্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যে ভেজাল বলতে মূলত বোঝায় বেশি দামের পণ্যের সাথে কম দামের পণ্যের কিংবা খাদ্যপণ্যের সাথে খাবারের অযোগ্য কিছু মিশিয়ে বিক্রি করা। যে খাদ্যের স্বাভাবিক গুণাগুণ কোনোভাবে প্রভাবিত বা যোজন বা বিয়োজন করে তার মৌলিক অবস্থাকে পরিবর্তন করে দেয় তাকে ভেজাল খাদ্য বলে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল বিষয়ে বাংলাপিডিয়ার ভাষ্য, খাদ্যে ভেজাল (Food Adulteration) বলতে বুঝি খাদ্যে নিম্নমানের, ক্ষতিকর, অকেজো ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মেশানো। প্রকৃতিগত ও গুণগত নির্ধারিত মানসম্মত না হলে যে কোনো খাদ্যদ্রব্যই ভেজালযুক্ত বিবেচিত হতে পারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য সাধারণত এ কাজ করে থাকে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে এসেছে, ৪০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল রয়েছে। এ ছাড়া বাজারে পাওয়া ৬০ শতাংশ শাকসবজিতে অতিরিক্ত কীটনাশক পাওয়া গেছে। ভেজাল খাদ্য ৩৩ শতাংশ মানুষের বিভিন্ন রোগ এবং পাঁচ বছর বয়সের নিচে ৪০ শতাংশ শিশুর অসুস্থতার প্রধান কারণ। ভেজাল ও দূষিত খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। (দৈনিক প্রথম আলো: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪)
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে চাই,কালাপানির আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নীল দ্বীপ ভ্রমণকালে খুঁজে পেয়েছি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়ার ‘ইউটোপিয়ান রাষ্ট্র’ ‘ময়না দ্বীপ’কে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং অর্থনৈতিক দারিদ্র্যতার মাঝেও সততার জীবন সংস্কৃতি সাধনার প্রমাণ পেয়েছি ভ্রমণকালে। তাছাড়াও আমার করোনাজনিত জটিল চিকিৎসাকালে মুম্বাই-দিল্লী-চেন্নাই-কলকাতা-কেরালায় দেখেছি,অভিজ্ঞতায় প্রমাণ পেয়েছি খাদ্যে ভেজালজনিত বহুবিধ অসুখের জীবন ও জটিলতা এবং তাদের সচেতন প্রয়াস। সুস্থ জীবন যাপনে সততার জীবন সংস্কৃতিচর্চার কোন বিকল্প নাই বলে আমার প্রতীতী বা ধারণা জন্মেছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ ভেজাল বলেই খাদ্যেও এত ভেজাল। লাভ আর লোভের মড়ক লেগেছে সমাজে,তা না হলে এত ভেজাল কেন? মানুষ ভেজাল,খাদ্যে ভেজাল,শিক্ষায় ভেজাল সর্বোপরি মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং অধিকারগুলোর বাস্তবায়নেও ভেজালময়তা দৃশ্যমান। বলা যায়, যে যার অবস্থানে মুনাফা লাভের জন্য উপলক্ষ করে মুখিয়ে থাকি। প্রয়োজনে মিষ্টি কথা বলি; নিজের স্বার্থের জন্য। চারিত্রিক ভেজালও একই অবস্থায়। নিজের স্বার্থেই ছুটছি। ভেজালের হাট-বাজারের দেশের প্রতিটি নাগরিককে স্পর্শ করে ভেজালের জাল। ‘নগর পুরলে যেমন দেবালয় রক্ষা পায় না’ তেমনিই রাষ্ট্রের চারটি উপাদানের এক নম্বর উপাদান মানুষ বা নাগরিক। সেই নাগরিক ‘মানুষ’ ভেজাল হলে রাষ্ট্রও বাদ যায় না। ভেজালমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র চাইলে মানুষের গুণগত পরিবর্তন জরুরি। যেটা শুরু করতে পারে আমাদের তরুণেরাই। শিক্ষার্থীদের তারুণ্যের উৎসব ভাবনা বা মোটো ‘এসো দেশ বদলাই,পৃথিবী বদলাই’ চেতনায় ধারণ করে ভেজালহীন জীবন গড়তে বলতে পারি-‘দেশ আমার দায়িত্বও আমার’ই।
ওয়াটার লুর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ফরাসী বীর নেপলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি রাখা হয়। কথিত আছে যে, প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে আর্সেনিক মিশিয়ে নেপলিয়নকে খেতে দেওয়া হতো। এভাবে স্লো-পয়জনিংয়ের মাধ্যমে ফরাসি সেনাপতি নেপলিয়নকে হত্যা করে তাদের চিরশত্রু ব্রিটিশরা। কিন্তু আজ আমরা নিজেরা নিজেদের স্লো-পয়জনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। দৈনিক সমকাল ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ২০২২ সালের ১ নভেম্বর প্রকাশিত শিরোনাম ছিলো- ‘ভেজাল খাদ্যের কারণে মানুষের দেহে জটিল রোগগুলো দ্বিগুণ হারে বাড়ছে’। ‘ভেজাল খাবারের কারণেই দেশে ওষুধের ব্যবসা এত বেড়েছে’। শিরোনাম দুটি মোটেই অতিকথন নয়, সত্য কথনই বটে। কারণ এখানে উপস্থিত আমাদের সকলের অভিজ্ঞতাই বলে বিষাক্ত ওষুধ মেশানো ভেজাল খাদ্য দিয়ে দেশ ভরে গেছে। যে খাবারগুলোই আমরা খাচ্ছি তার সবই প্রায় ভেজাল মেশানো। চাল, ডাল, মশলা, মাছ থেকে শুরু করে শাকসবজিসহ প্রায় সব খাদ্যেই বিষ মেশানো হচ্ছে। সেই বিষ মেশানো খাবারগুলো আমরা নিজেরা খাচ্ছি, আমাদের পরিবারের ছোট-বড় সবাই খাচ্ছে। ভেজাল খাদ্যের কারণে মানুষের দেহে ক্যানসার, কিডনিসহ বড় বড় জটিল রোগগুলো এখন দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাচ্ছে। ভেজাল খাবারের কারণেই দেশে ওষুধের ব্যবসা এত বেড়ে গেছে, হাসপাতালে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালের ফ্লোরেও রোগীদের এখন জায়গা হয় না। উন্নত দেশগুলোতে আর যাই হোক খাদ্যে বিষ মেশালে সেই কোম্পানি যত ক্ষমতাধরই হোক কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। আমাদের দেশে এখন হোটেলে ভেজাল খাবার, দোকানে ভেজাল খাবার, বাজারে ভেজাল খাবারসহ সর্বোত্র ভেজাল খাবার দেওয়া হচ্ছে। ভেজাল খাদ্যে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে শিশুরা এবং গর্ভবতী নারীরা। মানুষ যাবে কোথায়? খাবে কী? এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্থ জীবন দিতে হলে এই ভেজাল কারবারিদের এখনই থামিয়ে দিতে হবে। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এটি করতে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ভূমিকা আরও জোরালো করার পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং একযোগে কাজ করতে হবে।
এবার জানা যাক, গবেষকদের বিবেচনায় খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানোর অন্যতম কয়েকটি কারণ-
১.মানুষ রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রবণতা থেকে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশিয়ে থাকে। এ পদ্ধতি গ্রহণ করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জন করছে। এরা দুধে পানি মিশিয়ে ভেজাল দুধ বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করে। আবার,গুঁড়াদুধে ময়দা, সুজি ও অন্যান্য দ্রব্য মেশানো খুবই সহজ। এভাবে তারা প্রতিনিয়ত খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশিয়ে থাকে।
২.প্রশাসনিক নিয়মকানুনের দুর্বলতার কারণে এবং কঠিন দণ্ডবিধি বা শক্ত কোনো আইন কার্যকর না থাকায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিন্দনীয় এ কাজটির সঙ্গে অবলীলায় জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সাধারণ পণ্যেও ভেজালের প্রভাব পড়ে।
৩.নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবের কারণেও ব্যবসায়ীরা লোভে পড়ে নানারকম দুর্নীতি ও অসৎ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তারা ভেজাল মেশানোর মতো ঘৃণিত কাজকে অন্যায় বলে ভাবে না। তাই তারা অবলীলায় এ কাজ করে থাকে।
৪.এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিজস্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে সামান্য বাড়তি লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশিয়ে থাকে। তাদের এ অপকর্মের দরুন সাধারণ জনগণ যে ক্ষতির শিকার হবে তা তাদের চিন্তায়ও আসে না।
৫.আমাদের অধিকাংশ খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন এবং বিএসটিআই কর্তৃক প্রদত্ত ছাড়পত্র নেই। তাই ভুয়া লাইসেন্স কিংবা ছাড়পত্র দেখিয়ে তারা অবলীলায় ভেজালমিশ্রিত খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে।
৬.খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানোর পিছনে যত কারণই দায়ী থাকুক না কেন এর সবকিছুর মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের অর্থলোলুপ মানসিকতা ও সততার অভাব। এ কারণেই মানুষ অপরের ক্ষতি সাধনের বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। তাই তারা বাড়তি আয়ের আশায় খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো গর্হিত কাজ করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল রোধের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উপায়-
আমাদের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে।’একে বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সর্বাগ্রে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য এবং এসবের যোগানদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো প্রতিরোধ করতে গবেষকগণ বলেছেন নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-
১. বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানোর জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এর যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
২. খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেক জেলায় এবং বড় বড় বাজারগুলোতে পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে।
৩. ব্যবসায়ীদের খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের ভয়াবহ দিক সম্পর্কে জানিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার প্রয়াস চালাতে হবে।
৪. বিএসটিআইকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ভেজালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং বাজার তদারকির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. ভেজাল প্রতিকারের লক্ষ্যে ভোক্তা অধিকার রক্ষা তথা ক্রেতা স্বার্থ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
৬. সর্বোপরি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যের প্যাকেটের গায়ে কোম্পানির লাইসেন্স নম্বর, ট্রেড মার্ক,পণ্যের উৎপাদন সময়সহ এমন সব কৌশল ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে,যাতে ক্রেতা সাধারণ সহজেই খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল বুঝতে পারে।
৭. প্রচারমাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের নানারকম প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।
৮. ভেজালরোধে সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
৯. সমাজে ভেজালকারীকে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে,প্রয়োজনে লোকসমক্ষে তাকে লজ্জা দিতে হবে এবং ব্যবসায় থেকে তাকে বিতাড়িত করতে হবে।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা এটা প্রমাণ করছে যে, আধুনিক শিক্ষা দীক্ষা মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বিকশিত করছে কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়রোধে যে মূল্যবোধের প্রয়োজন তার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে সর্বত্র। শিক্ষা মানুষকে প্রজ্ঞাবান করলে বিবেকবান করতে অনেকাংশে ব্যর্থ। ফলে কখনো কখনো আমরা এমন আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠি যা আমাদের সমস্ত জ্ঞান গরিমাকে সমাজের চোখে বেমানান করে তোলে। ফলে ভেজালমুক্ত জীবন ও খাদ্যের প্রয়োজনে সৎ মানুষের খোঁজ আমাদের করতেই হয়। সততা, সৎ চিন্তা ভাবনা একটি মূল্যবান সম্পদ। সৎ চিন্তা ভাবনা একটি মানুষের জীবনের অন্যতম মূল্যবান গুণ। এটি শুধু নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করতেই সহায়ক নয়, বরং সমাজে একটি ন্যায় ও সৎ পরিবেশ গড়ে তুলতেও অপরিহার্য। সৎ চিন্তা আমাদের মনুষ্যত্বের ভিত্তি তৈরি করে এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য দিশা প্রদান করে। সুতরাং,সৎ চিন্তা ভাবনা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি মূল্যবান সম্পদ। এটি আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে সফলতা ও শান্তি নিয়ে আসে এবং আমাদের সত্যিকারের মানুষ করে তোলে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, চৈতন্যকে না বদলালে ‘ভেজাল রাজ’ থেকে মুক্তি নাই। চাই সততার জীবনচর্চার সংস্কৃতির সাধনা, সত্য বলার, সুপথে চলার মাববিক মূল্যবোধের সংস্কতির সাধনা। কারণ ভেজাল চিন্তা থেকেই সকল অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা ঘটে বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত। তাই ব্যক্তি মানুষের সংস্কার জরুরি। মহাজন লালন সাঁইজির চরণ স্মরণ করি, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।/মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে,তুই মূল হারাবি।’ তাই আমার বিবেচনা মানুষকে ‘মানুষ’ করে গড়ে তোলার মধ্যেই রয়েছে খাদ্যসহ সকল প্রকার ভেজাল থেকে মুক্তির পরম প্রত্যাশিত উপায়। সমাজ ও খাদ্য ভেজালমুক্ত হোক।
মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যে মাঝি ঈশ্বরী পাটনী দেবতার কাছে বর চেয়েছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। এখন নিশ্চয়ই কোনো মা দেবতার কাছে, সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার বর চাইবেন না। তবে আমরা চাই, আমার সন্তান দুধে-ভাতেই থাকুক, তবে সেই দুধটি যেন হয় নিরাপদ, তার সকল খাবার হয় ভেজালমুক্ত। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ‘তারুণ্যের উৎসব–২০২৫’-এর ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’- এই থিমটিকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের আশাবাদী মন বলে- ভেজালের লাভ ও লোভের অপসংস্কৃতি রোধে আমাদের চাই ‘মানুষ’ হওয়ার সাধনা, সততার জীবনদর্শন। কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কুসুমকুমারী দাশের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’র চরণ স্মরণ না করলেই নয়। কবি প্রত্যাশা করে লিখেছেন-
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে;
মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,
‘মানুষ’ হইতে হবে,–এই তার পণ। …
সাদা প্রাণে হাসি মুখে করো এই পণ–
‘মানুষ’ হইতে হবে, মানুষ যখন। …
হাতে প্রাণে, খাটো সবে, শক্তি করো দান,
তোমরা ‘মানুষ’ হলে, দেশের কল্যাণ।’
(তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা, নাগরিক ভয়েস, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারনেট)
(৩০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা আয়োজিত সেমিনারে পঠিত)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/এমই