ই-পেপার শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

মে দিবসের গল্প : লাল প্যাঁচা

বিল্লাল বিন কাশেম:
০১ মে ২০২৫, ১০:২৭

“যারা রক্ত দিয়ে অধিকার আনে, তাদের ঘাম দিয়ে নতুন ইতিহাস লেখা যায়। আর যারা ঘামেও লজ্জিত, তারা ভবিষ্যৎ নয়, কেবল অতীতের প্রেত।”

নাজমুলের বয়স তিরিশ পেরোয়নি। শরীর শক্তপোক্ত। ঢাকার পোস্তার এক পাটের গুদামে মজুরের কাজ করে। সারাদিন মাল ওঠায়, নামায়, বস্তা বয়ে চলে। গায়ের রঙ টকটকে কালো হয়ে গেছে রোদ আর ধুলোয়। কিন্তু তার চোখ দুটি জ্বলজ্বলে, যেন সেই চোখেই ইতিহাস জমে থাকে।

সকাল আটটায় তার কাজ শুরু হয়। আর চলে সন্ধে সাতটা অবধি। এক ঘণ্টার ছুটি দুপুরে। এইটুকু সময়েই হুড়মুড় করে খেয়ে নেয় নিজের সঙ্গে আনা শুকনো খাবার। আজকাল অবশ্য শুকনো খাবারও আনতে কষ্ট হয়।

একদিন দুপুরে বৃষ্টির ছাঁট আর গুদামের টিনচালের আওয়াজে ছায়া ঘনিয়ে এলে বসে বসে পুরনো চটের পাটাতনে হেলান দিয়ে চুপ করে ছিল সে। পাশে বসে থাকা শিপন বললো,

“দোস্ত, তোদের গ্রামে মে দিবসে কি হয়?”

নাজমুল হেসে বলল, “আমাদের গ্রামে মে দিবস মানে স্কুল বন্ধ থাকে। হেডস্যার একবার বলছিলেন— যারা বাঁচার জন্য লড়েছিল, তাদের জন্য একদিন। তখন বুঝি নাই।”

শিপন বললো, “এই লড়াই বুঝি আমরা করতে পারি না? আমরা কি তাদের মতো না?”

নাজমুলের চোখ তখন বাইরের দিকে। বৃষ্টির ফোঁটা ধুলে মুছে দিচ্ছিল পোস্তার গুদামের কার্নিশ। সে বললো—

“আমরা ওদেরই উত্তরসূরি। শুধু জানি না, কীভাবে মুখ তুলে কথা বলতে হয়।”

নাজমুলের বাবা নরসিংদীর একজন তাঁত শ্রমিক ছিলেন। যন্ত্রচালিত লুম আসার আগপর্যন্ত ভালই চলত। তারপর একদিন হঠাৎই তাঁত বন্ধ। বাবা হয়ে গেলেন বেকার। নাজমুল তখন ক্লাস ফাইভে। সংসারে খাবার নেই, আলো নেই। মা গৃহশ্রমিক হয়ে গেলেন। আর নাজমুল শহরের দিকে পাড়ি দিলো— শ্রম বিক্রি করতে।

প্রথমে ঢুকেছিল একটি চায়ের দোকানে। তারপর ধাপে ধাপে হোটেল বয়, নির্মাণ শ্রমিকের সহকারী, সবশেষে এখন এই গুদামের মজুর। জীবন এক ফাঁদ যেন, যে ফাঁদে সে নিজেই বন্দী।

কিন্তু নাজমুলের ভেতরে একটা আগুন জ্বলতো— নামহীন এক প্রতিজ্ঞার মতো। সে পড়ে, জানে, বোঝে। তার বুক পকেটে সবসময় একটা ছোট বই থাকে— “মেহনতি মানুষের ইতিহাস”। রাস্তার ফুটপাথের বই বিক্রেতার কাছ থেকে পাঁচ টাকায় কিনেছিল।

একদিন গুদামে এক নতুন লোক আসলো— নাম সেলিম। বয়সে তরুণ, চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। সে শ্রমিক হলেও, কথাবার্তা, চালচলনে অন্য রকম।

এক সন্ধ্যায় কাজ শেষে সেলিম বললো, “মে দিবস কী জানো?”

নাজমুল বললো, “জানি না বলতে পারি না। জানি কিন্তু সেটা হয়তো পুরোটা না।”

সেলিম তখন বলতে লাগলো ১৮৮৬ সালের শিকাগো শহরের সেই ইতিহাস। চার ঘণ্টার কর্মঘণ্টার দাবি, পুলিশের গুলিতে শ্রমিক হত্যা, হেইমার্কেটের ফাঁসি, “আনার্কিস্ট” শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পিস, পারসন্স, ফিশার— তারা কিভাবে মৃত্যুর মুখে গিয়ে বলেছিল— “দেখ, নীচের মানুষগুলোর হাতেই তৈরি হবে তোমাদের পতনের মাটি।”

নাজমুল চুপ করে শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, সেলিম শুধু ইতিহাস বলছে না, বরং তার বুকের ভেতরে একটা কিছু জ্বেলে দিচ্ছে।

গল্পটি এখান থেকেই মোড় নেয়।

সেলিম আসলে একজন সংগঠক। শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা ছড়ানোর জন্য কাজ করে। সে শুধু জ্ঞানের বীজ বোনে না, সংগঠিত হবার কথা বলে, অধিকার আদায়ের পথ শেখায়।

নাজমুল তার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। রাতে কাজ শেষে অনেক সময় তারা দুজন বসে কথা বলে, ছোট ছোট পত্রিকা পড়ে, দেয়াল লিখনের পরিকল্পনা করে।

একদিন তারা সিদ্ধান্ত নেয়— মে দিবসে গুদামের শ্রমিকদের নিয়ে একটি র‍্যালি করবে। ছোট, কিন্তু প্রতীকী।

মে দিবসের সকাল।

নাজমুল, সেলিম, শিপন আর আরও কয়েকজন লাল কাপড়ের ফিতা বেঁধে, হাতে পোস্টার নিয়ে বের হয়।

পোস্টারে লেখা—

“আমরা মজুর, আমরা মানুষ, অধিকার চাই।”

“৮ ঘণ্টা কাজের দাবি বাস্তব করো।”

“শ্রমিক মরছে, মালিক হাসছে— এ অন্যায়।”

সড়কে হেঁটে যাচ্ছিল তারা, চিৎকার করে বলছিল—

“শ্রমের মর্যাদা চাই, ন্যায্য মজুরি চাই।”

এই র‍্যালি পুলিশের চোখ এড়িয়ে যায়নি। এক দল পুলিশ এসে হুট করে তাদের থামায়। প্রশ্ন তোলে—

“ইউনিয়নের অনুমতি কোথায়? জোটের অনুমতি?”

সেলিম বললো, “এই দিন আমাদের, যারা রক্ত দিয়ে এই দিন বানিয়েছে, তাদের অনুমতি লাগেনা।”

পুলিশ বললো, “জোট বাঁধা বেআইনি।”

নাজমুল এবার প্রথমবারের মতো গর্জে ওঠে—

“যারা আমাদের শ্রম লুটে নেয়, তাদের তো কেউ বেআইনি বলে না!”

পুলিশ বেত্রাঘাত করে। সেলিমকে টেনে নিয়ে যায়। নাজমুল আহত হয়। র‍্যালি ভেঙে যায়।

সেদিন রাতে নাজমুলের মনে হচ্ছিল সে ভেঙে গেছে। কিন্তু বাস্তবে সে গড়েছে এক ভেতরের প্রতিরোধ। সেলিমকে মুক্ত করতে হবে। র‍্যালি আবার করতে হবে। এবার শুধু গুদাম না, আশপাশের সব গুদামের শ্রমিককে জড়ো করে।

সে রাতেই সে লিখে দেয় দেয়ালে—

“লাল প্যাঁচা জেগেছে, নিঃশব্দে নয়, গর্জনে। নাজমুল আসছে।”

পরবর্তী তিন মাস নাজমুল বদলে যায়। সে হয় সংগঠক।

সেলিম ছাড়া থাকতে পারছে না গুদামের মানুষ। তার অনুপস্থিতি শ্রমিকদের চেতনাকে জাগায়।

নাজমুল সেই শূন্যতায় ঢুকে পড়ে নেতৃত্বে। তারা গঠন করে একটা অঘোষিত ইউনিয়ন। চাঁদা তুলে সেলিমের জামিন দেয়। মালিক পক্ষ ভয় পায়, পুলিশেরাও আর তেমন টানাটানি করে না।

সেলিম বের হয়, নাজমুলকে দেখে হাসে—

“তুই তো আগুনের প্যাঁচা হয়ে গেছিস!”

নাজমুল বলে—

“আগুন জ্বালাতে হলে কেউ তো প্যাঁচা হতেই হবে।”

গল্পের শেষ নেই। এই লড়াই চলতেই থাকবে। প্রতিদিনের মতো আবার সকাল হবে। গুদামে মাল ওঠবে। শ্রমিকদের ঘামে বস্তা সরে যাবে। কিন্তু এবার আর নীরব শ্রমিক থাকবে না।

মে দিবসের শিক্ষা শুধু একদিনের নয়। নাজমুল জানে, যে আগুন তারা ধরিয়েছে তা দাবানলে রূপ নেবে একদিন।

নোট: ‘লাল প্যাঁচা’ একটি রূপক। এটি শুধু নাজমুল না, বরং বাংলাদেশের হাজারো নামহীন, অধিকারহীন শ্রমিকের প্রতিচ্ছবি— যারা প্রতিদিন পেটের দায়ে কাজ করে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে একটা আগুন বয়ে নিয়ে চলে।

এই গল্প আমাদের শেখায়— মে দিবস কোনো ছুটি নয়, এটি চেতনার দিন। যে চেতনা লড়াই শেখায়, সম্মান শেখায়, অধিকার আদায়ের সাহস শেখায়।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গণসংযোগ কর্মকর্তা

আমার বার্তা/বিল্লাল বিন কাশেম/এমই

আইনের শাসনই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আইনের শাসন। এই শাসন

জাগ্রত ছাত্র জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার পথরেখা

একটি জাতির চেতনার শিখা জ্বলে ওঠে যখন তার যুবসমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আমাদের দেশের

মে দিবসের সংকট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

শ্রমিকের ঘামেই সভ্যতার অট্টালিকা। কিন্তু আজ, শ্রমিক দিবস যেন কিছুটা কৃত্রিমতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। একদিনের

ইসরায়েল গাজা ও লেবাননের উপর আগ্রাসন বন্ধ করবে কবে?

জাতিসংঘ কর্তৃক ইসরায়েল গাজার যুদ্ধবন্ধের শান্তিচুক্তি সম্পাদন হলে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। এক সপ্তাহ না
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাত পায়ের নখ কাটার সুন্নত পদ্ধতি

ফিজিতে ‘দুর্দশায়’ ২৬ বাংলাদেশির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার গ্রহণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের দল ঘোষণা

রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের পরিচয়পত্র পেশ

৫ মে দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া, সঙ্গে থাকবেন দুই পুত্রবধূ

আমরা কোনো সাংবাদিকের চাকরি খাচ্ছিও না, দিচ্ছিও না: প্রেস সচিব

স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে স্বৈরাচার পুনর্বাসিত হতে পারে

ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল দুই বন্ধুর

স্কুলের মাঠ দখল করে পশুর হাট চায় না শিক্ষার্থীরা

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিতে এইড ফর মেন এর সংবাদ সম্মেলন

গাইবান্ধায় কৃষকদল-যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে মুসল্লিদের সড়ক অবরোধ

৫ মে বন্ধ থেকে বন্ধ হয়ে যাবে স্কাইপ: মাইক্রোসফট

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শুরু হয়েছে এনসিপির সমাবেশ

সুনির্দিষ্টভাবে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইলেন তারেক রহমান

ভারতীয় মিডিয়া ভয়ঙ্কর অপতথ্য ছড়াচ্ছে: শফিকুল আলম

অনুমতি ছাড়া হজ পালন না করার অনুরোধ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আগামী সাত মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: প্রেস সচিব

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে নাহিদের নতুন ভিডিওবার্তা

ছুটির দিনেও আজ ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, বিমানের ঢাকার ফ্লাইট বাধ্য হয়ে গেল সিলেট