
যমুনা অয়েলে তেল চুরির সিন্ডিকেট নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখতে ডিজিএম হেলাল উদ্দিন গঠন করে রেখেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে কিংবা প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো সেসকল কর্মকর্তা, কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করা হয়। প্রতিবাদকারীদের হয় হারাতে হয় চাকরী নয়তো হতে হয় বদলী, এমনকি মাঝে মধ্যে অনেককে আবার শারীরিক ভাবে নির্যাতনের শিকারও হতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে হেলাল সিন্ডিকেটের হয়ে প্রশাসনিক ভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করছে মো: মাসুদুল ইসলাম। একই সাথে তিনি যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মানবসম্পদ, মহাব্যবস্থাপক বিপনন এবং কোম্পানি সচিব। তিনটি পদ তিনি একাই দখল করে রেখেছে। পাশাপাশি চলতি মাসের ৩ তারিখে মাসুদুল ইসলামকে বিটুমিন সরবরাহ কমিটির আহবায়কের দায়িত্বও দেয়া হয় । মার্কেটিং কিংবা হিউম্যান রির্সোস ম্যানেজমেন্টের উপর নুন্যতম কোন ডিগ্রী নাই৷ অথচ যমুনা অয়েলের প্রধান কার্যালয়ে রয়েছে এই কর্মকর্তার পৃথক পৃথক তিনটি চেম্বার। অফিসারদের চেম্বার বন্টনের দায়িত্বেও তিনি ।এর সব কিছুর মুলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তফা কুদরুত -ই ইলাহির আর্শীবাদে। দুজনের গ্রামের বাড়ী একই এলাকায়। ২০১৬ সালে যমুনা ওয়েলের আভ্যন্তরিন একটি তদন্ত কমিটি রিপোর্টে মাসুদুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। তৎকালীন সময়ে তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশও করেছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলী সব কিছুতে মাসুদুল ইসলামের একক নিয়ন্ত্রণ। কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী অফিসে উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বও জিএম এইচ আর সেকশনের। এদিকে যমুনা অয়েল লেবার ইউনিয়নের সভাপতি আবুল হোসেনকে ইপিজেড থানা পুলিশ গ্রেফতার করে ২০ জুলাই ২০২৫। অথচ মজার বিষয় হলো ৯ আগষ্ট পর্যন্ত আবুল হোসেনকে অফিসে হাজিরা দেখানো হয়েছে ।২০ জুলাই থেকে ৯ আগষ্ট পর্যন্ত অর্থাৎ এই বিশ দিনের বিষয়ে অফিসিয়াল ভাবে কিছুই বলা হয়নি । এরপরও পরেও প্রায় পাঁচ মাস মাস ধরে অফিসিয়ালি অনুপস্থিত সিবিএ নেতা আবুল হোসেন । তবে জেলখানা থেকে ছুটির আবেদন করে এই সিবিএ নেতা, আবার সেই ছুটির আবেদন মন্জুর করে জিএম এইচ আর মো: মাসুদুল ইসলাম। শুধু আবুল হোসেনের বেলাতেই নয়, বিগত ফ্যাসিষ্ট সরকারের সুবিধাবাদীদের ভালো জায়গায় পোষ্টিং ও পদোন্নতি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে৷ কোন নীতিমালা ও বিভাগীয় প্রধানদের সুপারিশ তোয়াক্কা না করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তার ইচ্ছে মতো পাচজনের নামের প্রস্তাব পাঠায় পদোন্নতি সভায়। পরবর্তীতে এরা পদোন্নতিও পায়৷ যমুনা অয়েল সুত্রে জানা গেছে ২০২৫ সালের ৩১ আগষ্ট মাসুদুল ইসলামের স্বাক্ষরিত পদোন্নতি প্রাপ্ত তালিকাদের মধ্যে অন্যতম হলো কুতুবউদ্দিন হোসেন৷ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে জুনিয়র অফিসার পদে পদোন্নতি পাওয়া কুতুবউদ্দিন হলো নিষিদ্ধ সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র আজম নাসিরের চাচাতো ভাই । বিগত আওয়ামিলীগ সরকারের আমলে আজম নাসিরের হাত ধরেই তার চাকরীতে যোগদান। তবে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর থেকেই অফিসের কোন শৃঙ্খলা তোয়াক্কা করেননি। ইচ্ছে হলে অফিসে এসেছে ইচেছ না হলে আসেনি। তার এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য একবার খুলনা বিভাগীয় অফিসে বদলী করা হলেও আজম নাসিরের ক্ষমতার দাপটে সেই বদলি স্থগিত হয়ে যায়৷ কিন্তু বিতর্কিত এই কর্মচারীকে নিজের ইচেছমতো পদোন্নতি দিয়েছে জিএম এইচ আর মাসুদুলু ইসলাম। দ্বিতীয় পদোন্নতির তালিকায় আছে মো: সহীদুল আলম, তাকেও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে জুনিয়র অফিসার পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে । তার চাকরিও হয়েছে বিগত আওয়ামিলীগ সরকারের আলমে, তাও আবার রাউজানের সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর আর্শীবাদে। এছাড়া সহীদুল আলম ছিল ছাত্রলীগের সাবেক দুর্ধর্ষ ক্যাডার ও রাউজান ডিগ্রি কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগের মনোনীত সাবেক ভিপি । বিগত সরকারের আমলে একদিনের জন্যও অফিসে যেতে হয়নি তাকে। কিন্তু এবার তাকে দেয়া হয়েছে পদোন্নতি । পদোন্নতির তালিকায় আরও আছে ছাত্রলীগের ক্যাডার শেখ কামাল, ইকরাম ও মীর আরিফ। তাদের প্রত্যেককে কেরানি থেকে জুনিয়র অফিসার পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ।
বরাবরই দুনীর্তিবাজদের পক্ষে অবস্থান মাসুদুল ইসলামের। প্রতিষ্টানের ভিতরে যে কোন অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে তিনি নুন্যতম দ্বিধা করেনা। যেমন এজিএম অপারেশন (ডিপো) শেখ জাহিদ আহমেদ এবং ম্যানেজার, ডিপো ইনচার্জ ফতুল্লা ডিপো, মোহাম্মদ আসলাম খান আবু উলায়ীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি ফতুল্লা ডিপোতে পৌনে চার লাখ লিটার ডিজেল গায়েবের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে । তদন্তের স্বার্থে এই দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা , কিন্তু উল্টো পদোন্নতি তালিকায় এদের নামের প্রস্তাব পাঠায় মাসুদুল ইসলাম । যমুনা সুত্রে জানা গেছে ২৩ অক্টোবর ২০২৫ প্রতিষ্ঠানটির পদোন্নতি সভা ছিল । বিকেল ৫'১৫ মিনিটে ঢাকা লিয়াজো অফিসে এই সভায় যমুনা অয়েল, বিপিসির নির্দিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব ( পরিকল্পনা -২ অধি শাখা) আসমা আরা বেগম । একাধিক সুত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রস্তাবিত নামের তালিকায় শেখ জাহিদ আহমেদ ও মোহাম্মদ আসলাম খান আবু উলায়ীর নাম দেখে জোড় আপত্তি তুলেন এই উপসচিব। সকলকে পদোন্নতি দেয়া হলেও শুধু স্থগিত করা হয় দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার বেলায়।
সম্প্রতি ফতুল্লা ডিপোতে পৌনে চার লাখ লিটার ডিজেল গায়েব হওয়ার ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব কটি তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়ে কথা বলেছে ফতুল্লা ডিপোর অফিসার ( অপারেশন) ইমরান হোসেন। তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে হেলাল উদ্দিনের অন্যতম খলিফা জয়নাল আবেদীন টুটুলের বিভিন্ন অনিয়মের ফিরিস্তি ও তেল চুরির কাহিনি। তবে তার এই প্রতিবাদই শেষ পর্যন্ত তার জন্য কাল হয়ে দাড়ায় । ২৪ নভেম্বর মাসুদুল ইসলামের স্বাক্ষরে তাকে বদলী করা হয়েছে ঢাকা বিভাগীয় বিক্রয় অফিসে ( অফিসার সেলস পদে)। এদিকে সিন্ডিকেট প্রধান হেলাল উদ্দিনের দুই খলিফা, সিবিএ নেতা মুহাম্মদ এয়াকুব ও জয়নাল আবেদীন টুটুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াতো দুরের থাক, নুন্যতম বদলীর ব্যবস্থা পর্যন্ত নেয়নি। এই দুই জনের অন্যত্র বদলীর ব্যাপারে প্রশ্ন উঠলেই মাসুদুল ইসলামের সেই পুরানো ডায়লগ, নির্বাচিত সিবিএ নেতাদের বদলী করার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা আছে । কিন্তু চলতি বছরের ২৮ আগষ্ট বিদ্যুৎ, জালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ আইন শাখা হতে সিনিয়র সহকারী সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিপিসিকে দেয়া চিঠিতে বদলির বিষয়টি স্পষ্ট করে। সেই চিঠিতে বলা হয় শ্রম আইনের ১৮৭ নং ধারায় কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি (ও সাধারণ সম্পাদক সহ কোন কর্মকর্তাকে তাহাদের) সম্মতি ব্যতিরেকে একজেলা থেকে অন্য জেলায় বদলী করা যাবেনা। তবে জালানি সেক্টরের জন্য এধারা প্রযোজ্য হবেনা।
২০২০ সালের ২১ জুনে মাসুদুল ইসলাম ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ডিজিম ( একাউন্টস)। সেসময় জিএম অপারেশন বরাবর তার দেয়া একটা চিঠির বিষয়বস্তু হলো তেলের ক্ষতি প্রসঙ্গে। সেই চিঠিতে বলা হয়, মংলা অয়েল ইনষ্টেশন ডিপোর এপ্রিল ২০২০ মাসের এফও এর ট্যাংকে মজুদ এবং লাভ/ক্ষতির সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, তেলের কোনো ধরনের অপারেশন বিহীন ২০ এপ্রিল ২০২০ তারিখে ৩১° সে: তাপমাত্রায় মোট ২৯৯২৫ লিটার কার্যকালীন ক্ষতি দেখানো হয়েছে। উল্লেখিত ক্ষতি কিভাবে সমন্বয় করা হবে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং সদয় সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো । তবে এই ঘটনার পাঁচ বছর হয়ে গেলেও কোন সুরাহা হয়নি । অভিযোগ উঠেছে এই ঘটনার সাথে অভিযুক্ত তৎকালীন মংলা ডিপো ইনচার্জ আনিসুর রহমানকে বরিশাল ডিপোর মতো ভালো জায়গায় পোষ্টিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয় এই মাসুদুল ইসলাম।
প্রতিষ্ঠানটিতে তার চাকরি জীবন শুরু ১৯৯৬ সালের ১৪ অক্টোবর। তবে চাকরি জীবনে সিন্ডিকেট প্রধান হেলাল উদ্দিনের মতো তিনিও মালিক হয়েছে কোটি কোটি টাকার। চট্টগ্রাম হালিশহরের ব্লক এল, লেইন -১ রোড -১ বাড়ি নং ২২ দ্বিতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার । চউক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাকলিয়ার কম্পোলেক আবাসিক প্রকল্পে আছে দুটো প্লট। ইতিমধ্যে একটি প্লটে ভবন নির্মাণ শুরু করেছে। একই এলাকায় আছে বৃহৎ একটি ডেইরি ফার্ম। বিনিয়োগ করে রেখেছে চট্টগ্রাম ষ্টক এক্সচেঞ্জে নামে বেনামে শত কোটি শেয়ার।
আমার বার্তা/এমই

