সম্প্রতি ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনকে পাশে নিয়ে রাজধানী বেইজিংয়ে সামরিক কুচকাওয়াজে হাজির হন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
বিশ্লেষকদের মতে, টানা কূটনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন— দেশে ও বিশ্বমঞ্চে এখনো তিনিই ‘একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে’। শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
বার্তাসংস্থাটি বলছে, ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম সামরিক কুচকাওয়াজে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার দুই পূর্বসূরিকে পাশে বসিয়ে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার বার্তা দিয়েছিলেন।
এক দশক পর, তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দেশে তার বিরোধীদের সরিয়ে দিয়ে গত বুধবার ৮০তম বার্ষিকীর কুচকাওয়াজে তার পাশে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। বিদেশি অতিথিদের মাঝে বসানো হয়েছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদেরও।
কুচকাওয়াজের আগে শি জিনপিং অংশ নেন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠকও হয়। এর আগে তিনি তিব্বত সফর করেছিলেন। আর এটি ছিল বিরল ঘটনা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বয়স এখন ৭২ বছর। তার এই বয়স ও উত্তরসূরি প্রসঙ্গ নিয়ে যে জল্পনা তৈরি হয়েছিল, টানা কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা খানিকটা প্রশমিত হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক মন্থরতার চাপ থেকেও মনোযোগ সরিয়ে দিতে পেরেছেন জিনপিং।
বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে মঞ্চে উঠতে গিয়ে শি জিনপিং ও পুতিনকে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও মানুষ ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে কি না, তা নিয়ে আলাপ করতে শোনা যায়।
এশিয়া সোসাইটির গবেষক নিল থমাস বলেন, “এসব কূটনৈতিক পদক্ষেপ প্রমাণ করে, কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শি জিনপিংই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে আছেন। পূর্বসূরিদের মতো প্রবৃদ্ধি দিয়ে বৈধতা অর্জন সম্ভব না হওয়ায় তিনি জাতীয়তাবাদকে সামনে আনছেন।”
শি জিনপিং এবার উপস্থিত হয়েছিলেন ধূসর মাও স্যুট পরে— যা তার পাকা চুলের সঙ্গে মিলিয়ে এক প্রবীণ রাষ্ট্রনায়কের ইমেজ তৈরি করে। পাশে থাকা নেতাদের কালো স্যুট কিংবা এক দশক আগের তার নিজের কালো পোশাকের সঙ্গে এর ছিল তীব্র বৈপরীত্য।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াংয়ের ভূমিকা সীমিত হয়ে গেছে। তিনি কেবল মালয়েশিয়া ও উজবেকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলো সামলান পার্টির কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের প্রধান চাই ছি।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক বৈঠকগুলো উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব জোরদার করেছে এবং শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং।
গত সপ্তাহে চীন সফর করা অনেক দেশের ওপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আরোপ করেছেন। এর মধ্যে ভারতও রয়েছে। দেশটি এখনও রাশিয়ার তেল কিনছে। উল্লেখযোগ্য মুহূর্তে দেখা যায়— মোদি ও পুতিন হাত ধরে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলাপ করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা যে তারা ভারতকে পুরোপুরি রাশিয়া-চীন বিরোধী শিবিরে টানতে পারেনি। এক কৌশলগত পরামর্শক সংস্থার পরিচালক ইভেন পে বলেন, “এসসিওর এই প্রদর্শিত ঐক্যের অন্যতম চালিকাশক্তি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি।”
ট্রাম্প কুচকাওয়াজকে “চমৎকার” বলে প্রশংসা করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটাক্ষ করে লিখেছেন, চীন, পুতিন ও কিম মিলে “যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে”। তবে ক্রেমলিন বলেছে, তারা ষড়যন্ত্র করছে না, বরং ট্রাম্পের মন্তব্য ছিল ব্যঙ্গাত্মক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, টানা কূটনৈতিক কর্মযজ্ঞ চীনের সেই বার্তাই জোরালো করেছে যে তারা উন্নয়নশীল বিশ্বের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হতে চায়। বিনিয়োগ, নতুন উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে।
চায়না-গ্লোবাল সাউথ প্রজেক্টের প্রধান এরিক ওল্যান্ডার বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রকে যখন অনেক দেশ ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক শক্তি হিসেবে দেখছে, তখন চীন নিজেদেরকে তুলনামূলক স্থিতিশীল বিকল্প হিসেবে তুলে ধরছে। তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের স্বপ্নকে সামনে রেখে চীনের প্রস্তাবনা ভবিষ্যতমুখী মনে হচ্ছে।”
তবে শি জিনপিংয়ের সামনে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর তা হচ্ছে- বিরাট জোটের ভেতর দ্বন্দ্ব সামলানো এবং ২০২৭ সালে সম্ভাব্য চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে নিজের অবস্থান আরও দৃঢ় করা।
চীনের দীর্ঘদিনের নীতি, সীমান্ত বিরোধ বা ভর্তুকি দিয়ে সস্তা পণ্য রপ্তানি— এসব বিষয় বিশ্বমঞ্চে দ্বন্দ্ব বাড়িয়েই চলবে। আর ভারতের সঙ্গে তার টানাপোড়েন এক বৈঠকেই মিটে যাবে না।