একুশের চেতনা যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। আমরা যখন ছাত্র তখন ফেব্রুয়ারি এলেই দেখতাম ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- এই গানটি বেজে উঠত পাড়া-মহল্লায়। তখন চেতনায় গা শিউরে যেত আমাদের। এখন দেখি ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখটাতে শুধু আনুষ্ঠানিকতা চলে। শিক্ষার্থীদের মাঝে আগের সে অনুভূতি যেন কমতে শুরু করেছে। আমরা যখন ছাত্র তখন একুশের র্যালি মানেই যেন অন্য এক অনুভূতি। প্রস্তুতি চলত কয়েক দিন ধরে। একুশের সকালের র্যালিতে সবাই খালি পায়ে হাজির হতাম। কাউকে সড়কে সেদিন জুতা পরে হাঁটতে দিতাম না আমরা। আমরা একুশের চেতনা মনেপ্রাণে ধারণ করতাম। দিন দিন সেই অনুভূতি যেন ভোঁতা হয়ে আসছে। একুশের চেতনা কমতে শুরু করেছে নতুন প্রজন্মের কাছে। ফেব্রুয়ারি এলেই এখন বাংলা ভাষা নিয়ে হইচই হয়; আবার মার্চেই চলে ভিনদেশি ভাষার চর্চা। মায়ের ভাষাকে বাঁচানোর তাগিদ আসে বছরে এই একটি মাসেই। বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষা আন্দোলন স্কুলের পাঠ্যবইয়েই যেন সীমাবদ্ধ। একুশের ভোরেই শুধু অধুনা মানুষের গন্তব্য হয় শহীদ মিনারে।
দেশে বাংলা ভাষার অবমাননা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভুলে ভরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টারেও বানানরীতি মানা হচ্ছে না। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পরও ভুল বানানের ছড়াছড়ি সর্বত্র। যুগের পর যুগ নানাভাবে এ বিষয়ে কথা উঠলেও বাংলার অবমাননা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এমনকি এ-সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশেরও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। রাজধানীর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই নামকরণ করা হয়েছে বিদেশি ভাষায়। কোথাও আবার বিদেশি শব্দ লেখা হয়েছে বাংলায়। আবার কোথাও অহেতুক বাংলা শব্দকে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। আবার কোথাও-বা বাংলা-ইংরেজির মিশেল আর ভুল বানানের ছড়াছড়ি। ঢাকার প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। উত্তরা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত শত শত বিপণিবিতান আর দোকানের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়- প্রায় সবই ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড। শহরজুড়ে মোবাইল ফোন কোম্পানির ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজি ভাষা। হাউজিং কোম্পানির বিলবোর্ডেরও দশা একই। খাবারের দোকানে বিরিয়ানি না লিখে লেখা হয়েছে ‘বিরানী’, কোথাও লেখা হয়েছে ভর্তার পরিবর্তে ‘ভরতা’ এ রকম অসংখ্য ভুল।
নবাবি আমলে বাংলা ভাষার অনেক ভাঙাগড়া হয়েছিল। ঢুকে পড়েছিল ‘কুর্শি’, ‘দরজা’, ‘পেয়ালা’, ‘শরবত’ ইত্যাদি অনেক আরবি, ফার্সি শব্দ। এবার কি বেনো জলের মতো ঢুকে পড়বে হিন্দি, ইংরেজি, ‘জানেমন’, ‘চিপকলি’, ‘মজাক’, ‘নউটাঙ্কি’, ‘ড্রামাবাজি’র মতো শব্দ? স্বদেশে, পরদেশে, প্রবাসে বাঙালিদের মুহূর্তে বদলে যাওয়া মতিগতির সঙ্গে পালটে ফেলা টিভি চ্যানেলের মতো ‘মেড ইজি’ করতে কি বাংলা ভাষা এবার দোর খুলে দেবে অভিধানের? হবে নাকি, নতুন ভাষার নতুন কথার, নতুন নতুন মানে? সংস্কৃতের অপভ্রংশ মাগধী-প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয় ১০০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। জন্মের প্রথম লগ্ন থেকেই এই ভাষা এতটাই উন্নত এবং সমৃদ্ধ যে, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অগণিত মানুষকে এক সূত্রে বাঁধতে পেরেছিল। গড়ে তুলেছিল বাংলা সংস্কৃতি ও জাতি। কিন্তু মাতৃদুগ্ধসম এমনই এক ভাষাকে যখন বর্জন করার আদেশ এলো তখন সন্তানদের বুকে খুব স্বাভাবিকভাবেই বেজে উঠেছিল বিদ্রোহের দামামা, যা আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে।
বাংলা ভাষা প্রয়োগে কোথায় যেন এক ধরনের অবহেলা। কোথায় যেন এক ধরনের হীনম্মন্যতা। কেন এমন করা হয়? এসব প্রশ্নের যেন কোনো জবাব নেই। অফিস, বাসা কিংবা রেস্তোরাঁয় বাংলার চেয়ে ইংরেজির প্রয়োগ বেড়েছে। অনুষ্ঠানে, রাস্তায়, গাড়িতে, পার্কে প্রায় সব জায়গাতেই হিন্দি কিংবা অন্য ভাষার গানের এখন জয়জয়কার। কালে কালে এই বুঝলাম যে, বেশির ভাগ বাঙালিই বাংলার চৌহদ্দি পেরোলেই বাংলা ভাষাটাকে পুরোনো ঘরে ফেলে আসা আসবাবের ঝুলধরা তাকের কোণে ঝং ধরা টিনের বাক্সে বন্দি করে আসে। সঙ্গে আনে ‘আমি বাঙালি’ নামক তকমা, যদিও তা হাতির দাঁতের মতো শুধুই বাহারি। বলতেই হয় সারা দেশে আজ বাংলা ভাষার অবমাননা চলছে। অথচ সারা পৃথিবীতে বাংলা এখন ষষ্ঠ ভাষা হিসেবে স্থান পেয়েছে। হাজারো ভাষার মধ্যে পৃথিবীতে আমরা যদি আমাদের ভাষার এই গৌরবজনক অবস্থানকে গুরুত্ব না দিই, তবে তার চেয়ে মর্মবিদারক আর কিছু আছে কি? উনিশ শতকে বাঙালি কৃতী চিকিৎসকরা বাংলা ভাষায় বই লিখেছেন। বিচারকরা বাংলা ভাষায় বিচারের রায় লিখেছেন আর চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনটিও বাংলা ভাষায় লেখেন না। আদালতে নাকি বাংলা ভাষা ব্যবহারটা জুতসই না!
গত তিন দশকে কত কিছুই তো আমাদের সামনে পাল্টাল। আমরা অনেকেই সেই রেকর্ড প্লেয়ার আর রেডিওর মায়া ত্যাগ করে ধরেছি টিভি। ছোটবেলার সেই মুড়ির টিনখ্যাত পাবলিক বাস এখন বিলাসবহুল হয়েছে। ভ্রমণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শীতল হাওয়া। গুলিস্তানের মতো ক্ষত-বিক্ষত সড়কের নিচে এখন পাতাল সড়ক আর মার্কেট গড়ে উঠেছে। কবছর বাদেই হয়তো পাতালে চলবে আধুনা রেলগাড়ি। এত কিছুর পরও কী করে বলি যে বাঙালি বদলায়নি? কে বলে যে বাঙালি পরিবর্তন চায় না? দলে দলে শহর, গ্রাম উজাড় করে এই যে আমরা দেশে, বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছি, কেন? মাত্র বছর কুড়ি আগেও যে ঠোকাঠুকি, চুলোচুলি, ঝগড়াঝাঁটির একান্নবর্তী সংসার ছিল, তা আজ ‘ছোট পরিবার, সুখী পরিবার’ হয়েছে। কেন বড় দোমহলা বাড়ির বিলাসিতা ছেড়ে আজ সবার কাম্য ‘টু বেডরুম, ডাইনিং ও কিচেন’। কেন পুরোনো, প্রাসাদোপম বাড়ি, বাজার ভেঙে চাই অত্যাধুনিক ‘মল’, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। চওড়া রাস্তার বুকে গজিয়ে তুলি উড়ালপুল। এসব কি পরিবর্তন নয়? এ পরিবর্তনেরও প্রয়োজন আছে। তবে আমূল পরিবর্তন এসেছে ভাষা প্রয়োগেও। কিন্তু এ পরিবর্তন কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরা কি চেয়েছিলাম মায়ের ভাষাটাকে বিকৃত করে দিতে; বদলে নিতে?
বাংলা ভাষা নিয়ে তর্ক বহুদিনের পুরোনো। বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুহিতা জেনে অনেকে গৌরব বোধ করেন। অনেকের আবার এ ধরনের জন্মগত সম্পর্ক মেনে নিতে রয়েছে প্রবল আপত্তি। এ তর্ক নতুন করে শুরু করার আগে আসুন আমরা আলোচনা করে ঠিক করি, ‘বাংলা ভাষা’ বা ‘সংস্কৃত ভাষা’ বলতে আমরা কী বুঝব? ‘বাংলা ভাষা’র দুটি সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ভারতের বিহার, আসাম ও মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে সর্বজনবোধ্য যে মান উপভাষাটি আছে যাকে সাধারণভাবে ‘মান চলিত বাংলা’ বলা হয়। সেটাকে ‘বাংলা’ বলা যেতে পারে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে প্রচলিত বিশেষ কিছু ইন্দো-আর্য্য উপভাষার (যেমন- চট্টগ্রাম, সিলেট, মেদিনীপুর, বীরভূম অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষা) সমষ্টিকেও ‘বাংলা ভাষা’ বলা যেতে পারে। ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি সব ভাষার ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা আছে। তবে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ইংরেজি বা ফরাসির মতো ভাষার ক্ষেত্রে একাধিক মান ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে (যেমন- যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রে আলাদা আলাদা মান ইংরেজি রয়েছে, ফ্রান্স আর কানাডার কুইবেকে রয়েছে আলাদা আলাদা মান ফরাসি)। সুতরাং ‘ইংরেজি’ বা ‘ফরাসি’ বলতে বোঝাবে সেই মান ভাষাগুলোর যেকোনো একটিকে বা একসঙ্গে ইংরেজি বা ফরাসির সবগুলো উপভাষাকে। মোট কথা, বর্তমান পৃথিবীতে ‘ভাষা’ কথাটির অন্তত দুটি আলাদা অর্থ রয়েছে : ১. সর্বজনবোধ্য মান উপভাষা এবং ২. সবগুলো উপভাষার সমষ্টি। সুতরাং ১. ‘বাংলা’ বলতে সর্বজনবোধ্য মান বাংলাকে বোঝাতে পারে আবার ২. সবগুলো আঞ্চলিক বাংলা সমষ্টিকেও ‘বাংলা’ বলা যেতে পারে। কিন্তু তা কোথায়?
আজ বাঙালি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা শীর্ষস্থানও লাভ করেছে এবং করছে। কিন্তু যে ভাষার নামে তাদের পরিচয় সেই ভাষা তাদের রোজকার জীবনে কোন স্থানে রয়েছে? বিশ্বের দরবারে সে কতটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে? ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ বা তাদের স্বপ্ন আজ কতটা সফল? একুশের চেতনা আজ আমাদের মন কতটা ধরে রাখতে পেরেছে? এই প্রশ্নগুলো আজও সামনে এসে পড়ে! আধুনিক প্রজন্ম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আজ ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না, তাদের পড়াশোনার মাধ্যমও ইংরেজি হলে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। বাংলা ভাষার এ অবহেলার অবসান ঘটুক। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে এটাই আমাদের আকাক্সক্ষা। বাংলা ভাষার চেতনা উজ্জ্বল করে তুলতে সবার উদ্দেশে আহ্বান, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের প্রতি ‘তোমরা বাংলা ভাষাকে জায়গা করে দাও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।’ রাজনীতিকদেরও বাংলা ভাষার ব্যাপারে আরো অনেক বেশি সচেতন হতে হবে; আমাদের অবশ্যই বর্তমান অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাকে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে দিতে হবে। আর এটাই হোক ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে আমাদের বিশেষ প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।
আমার বার্তা/মীর আব্দুল আলীম/এমই