ডেঙ্গুু প্রতি বছরই দুশ্চিন্তার কারণ হলেও এবছর একটু বেশিই ভয়ংকর রুপে দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ হয়ে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা গত ২৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। গত দুই মাসে ১৬৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এখনও সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় চার হাজার ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। মৃত্যু ছিল ৮৫৩ জন। ওই ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয় ৩ লাখ ২১ হাজার জন। এর মধ্যে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। গত এক মাসে ডেঙ্গুর এমন ঊর্ধ্বগতির পেছনে বিশেষজ্ঞরা দুটি কারণের কথা বলছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর আগে গত এক দশকে (২০১৪-২৩) সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর পিক সিজন হয় পাঁচবার। অক্টোবরে তিনবার, নভেম্বর ও আগস্টে একবার করে পিক সিজন হয়েছে।
প্রথমত, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অতিবৃষ্টির কারণে রোগটি বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব। চলতি বছর বাড়ছে শিশু মৃত্যুর হারও। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় ৩১ হাজার রোগীর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৫ হাজারই (১৮ শতাংশ) শিশু। আর এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৩ শিশুর। আক্রান্তদের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক মানুষ বেশি হলেও শিশুর (১৫ বছর পর্যন্ত) সংখ্যা মোট আক্রান্তের ১৮ শতাংশ। চলতি বছরে শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া পাঁচ শিশুর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে সেপ্টেম্বরে। আর ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৪৮ জন। বাংলাদেশে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪ এই চার ধরনের ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হয়। এবার যেসব শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে তাদের ৮৭ শতাংশই ‘ডেন-২’ জিনগত ধরনে আক্রান্ত। বাকি ১৩ শতাংশ শিশু আক্রান্ত হচ্ছে ‘ডেন-৩’ ধরনে। প্রশ্ন হলো ডেঙ্গু থেকে আমাদের মুক্তি কিভাবে? করোনা মহামারীতেই আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে অবহেলা স্পষ্ট ছিল। তাছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে এর সমাধান কোথায়? এর কার্যকরী সমাধান সম্ভব টিকা প্রয়োগে। শরীরেই যদি প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে তাহলে রোগ হবে না।
পৃথিবী জুড়েই অতি ক্ষুদ্র কিন্তু ভয়ংকর একটি প্রজাতির প্রাণী হলো মশা। প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় এই প্রাণী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে যে, চলতি বছরই আক্রান্ত রোগীর হিসেবে ডেঙ্গু রেকর্ড করতে যাচ্ছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বিশ্বে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। পৃথিবীর প্রায় শতাধিক দেশেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। তবে আমাদের দেশে একটু বেশিই বিস্তার করেছে এডিস মশা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিভির খবরে অপেক্ষা করতে হয় আজ কতজন আক্রান্ত ও মৃত্যু ঘটেছে। প্রতিদিন মানুষ মরছে ডেঙ্গুতে। ডব্লিউএইচও জানায়, বিশ্বের বৃষ্টিবহুল ও উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে এই রোগ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পরছে। ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইউরোপের উত্তর ও পশ্চিম দিকে এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশার বিস্তার ঘটছে। এই প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বাহক। অর্থাৎ বিশ্ব উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বজুড়েই মশার উপদ্রব এবং বংশ বিস্তার বাড়ছে যা উদ্বেগজনক। এই বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে মশা নিধনের পাশাপাশি জোর দিতে হবে টিকায়। আমরা দেখেছি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকরী ছিল এর ভ্যাকসিন। যে দেশগুলো যত দ্রুত করোনার টিকা জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে পেরেছিল সেই দেশ তত দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে পেরেছিল। আমাদের দেশও ছিল দ্রুত করোনার টিকা দেওয়ার দেশ।
যেহেতু এখন ডেঙ্গু কেবল একটি ঋতু ভিত্তিক সমস্যা না বা এর আক্রান্ত এবং মৃত্যু বাড়ছে সেহেতু টিকাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। যদিও এটি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এটাই সবচেয়ে কার্যকরী। ইতিমধ্যেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী অগ্রগতি হয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি টিকা 'কিউডেঙ্গা'র অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দুই ডোজের এই টিকা শুধুমাত্র ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর আগে সানোফি-এ্যাভেন্টিজের তৈরি ডেঙ্গু টিকা 'ডেঙ্গাভেস্কিয়া'র অনুমোদন দিয়েছে কয়েকটি দেশ। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের সফল পরীক্ষা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকেরা এই টিকার সফল ট্রায়াল (পরীক্ষা) করেছেন। বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবির সহায়তায় 'টিভি০০৫' নামে একটি ডেঙ্গু টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ। এই পরীক্ষার প্রথম দুই ধাপে তারা সফলতা পেয়েছে। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা সফল হলে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে। গণমাধ্যম থেকে এই তথ্য জানা গেছে। সুতরাং আমরাও ডেঙ্গুর টিকা প্রয়োগের দিকেই ধাবিত হচ্ছি। এটাই সমাধান। কিন্তু যতদিন টিকা না আসে ততদিন তো আমাদের টিকতে হবে। মশা নিধন, বংশ বিস্তার রোধ এবং সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। টিকা পেলেও এসব অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন ২০২৩ সালে। ওই বছর সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয়। আর গত বছরের ডিসেম্বরে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া প্রতি ছয়জনের একজন শিশু, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
এবার আসা যাক ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের দেশের ব্যর্থতার কারণ কী? ডেঙ্গু প্রতিরোধে এর আগেও বেশ কিছু পদক্ষেপ চোখে পড়েছে। এর মধ্যে জনগণকে সচেতন করা, বিভিন্ন বাসা বাড়িতে ডেঙ্গু বিস্তারের স্থান বিনষ্ট করা, জরিমানা করা এবং ওষুধ ছিটিয়ে কার্যক্রমগুলো চোখে পড়েছে। ব্যয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। কিন্তু কাজের কাজ যে কিছুই হয় নি তা বোঝা যায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা দেখলেই। এখানেও রয়েছে দুর্নীতি, এখানেও রয়েছে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব। যে দেশগুলো ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফল হয়েছে সেই দেশগুলো কি করেছে সেসব বিবেচনায় না নিয়ে অকার্যকর পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। মশার প্রজনন ধ্বংস করা দরকার সবার আগে। ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। আদৌ সেসব ওষুধে মশা কতটুকু মারা যায় সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ টাকা ঠিকই গেছে। ছিল সমন্বয়ের অভাব। এ বছর যদি ডেঙ্গুকে মহামারী হিসেবে না দেখতে চাই তাহলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সব পক্ষের সমন্বয় দরকার।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, পাবনা।
আমার বার্তা/জেএইচ