বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নানা পরিবর্তন ও উত্থান-পতন চলতেই থাকে। তবে, আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সামগ্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিশেষত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের পর, দেশের উন্নয়ন ধারার প্রতি নানান প্রশ্ন উঠেছে এবং সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি। এই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের উন্নতির জন্য কিছু মৌলিক সংস্কারের কথা এখন সময়োপযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে, আমরা বাংলাদেশে বিপ্লবোত্তর যে সংস্কার প্রয়োজন, তার কিছু প্রধান দিক সম্পর্কে আলোচনা করব।
১. রাজনৈতিক সংস্কার:
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ভাঙা প্রতিশ্রুতির শিকার হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে উত্তেজনা এবং সংঘাতের কারণেও মানুষের আস্থাহীনতা বেড়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লবের পর, রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্ন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের প্রকৃত বিকাশের জন্য ন্যায্য নির্বাচন, দলীয় সংহতি এবং রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সঠিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি স্বাধীন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করা উচিত, যাতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ। একে অপরকে ক্ষমতার দখলদারি হিসেবে না দেখে, তারা একে অপরকে সহযোগী হিসেবে ভাববে, যা দেশের উন্নতির জন্য সহায়ক হবে।
২. অর্থনৈতিক সংস্কার:
৫ আগস্টের বিপ্লবের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছে। তবে, এই বিপ্লবের মাধ্যমে কিছু নতুন দিক উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করতে, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন।
প্রথমত, কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কৃষি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত, কিন্তু এই খাতের উন্নতি এখনো সঠিকভাবে হয়নি। কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির সরবরাহ এবং সঠিক সহায়তা প্রদান করা উচিত। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের (SME) উন্নয়নে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। তৃতীয়ত, দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে, তাই সরকারকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।
৩. শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার:
দেশের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তাদের শিক্ষার ওপর। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আজকের প্রয়োজনীয়তার অন্যতম শর্ত। ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি মৌলিক সংস্কারের সময় এসেছে।
প্রথমত, পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বিশ্বব্যাপী কার্যকরী শিক্ষা পদ্ধতিকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা আধুনিক শিক্ষা প্রদানে সক্ষম হয়। তৃতীয়ত, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং সেগুলোর মান নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে, ছাত্রছাত্রীরা একটি ভালো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, যা তাদের কর্মসংস্থানের জন্য সহায়ক হবে।
৪. স্বাস্থ্যখাতে সংস্কার:
স্বাস্থ্যখাতের সঠিক উন্নতি দেশের নাগরিকদের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বর্তমানে নানা সমস্যা বিদ্যমান, যার মধ্যে রয়েছে সেবার মান, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং চিকিৎসকদের প্রাপ্যতা। ৫ আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবের পর, স্বাস্থ্য খাতে গভীর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে।
প্রথমত, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি করা জরুরি। দেশের হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো ও চিকিৎসা সরঞ্জামগুলোর আধুনিকীকরণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগণের জন্য। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করা জরুরি। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবায় দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে এবং চিকিৎসকদের সম্মান ও তাদের সেবা প্রদানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. আইন-শৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার:
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় কয়েকটি বড় সমস্যা বিদ্যমান, যার মধ্যে রয়েছে সুশাসন এবং ন্যায়বিচারের অভাব। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর বিপ্লবের পর, মানুষের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। বিচার ব্যবস্থা আরও দ্রুত এবং নিরপেক্ষ করতে হবে।
প্রথমত, বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন এবং দ্রুতগতি করার জন্য আরও আইনগত সংস্কার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, পুলিশ বাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং তাদের প্রশিক্ষণের মান উন্নত করতে হবে, যাতে তারা জনগণের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হয়। তৃতীয়ত, মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৬. পরিবেশ সংরক্ষণ:
বাংলাদেশের পরিবেশ বর্তমানে বিপর্যস্ত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বনভূমি ধ্বংসের মতো সমস্যা দেশটির ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
প্রথমত, দেশের বনাঞ্চল রক্ষা এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয় করে কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে প্রচার অভিযান চালাতে হবে।
৫ আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লব বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ফিরিয়েছে। এই বিপ্লবের পর, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা এবং পরিবেশ খাতে যে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন, তা দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তবে বাংলাদেশ একটি আধুনিক, উন্নত এবং শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
লেখক: সাইফুল্লাহ হায়দার, কেন্দ্রীয় সংগঠক, জাতীয় নাগরিক কমিটি
আমার বার্তা/জেএইচ