ই-পেপার রবিবার, ১০ আগস্ট ২০২৫, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২

আধুনিক কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ: বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি

সাকিফ শামীম:
০৬ আগস্ট ২০২৫, ১৯:০৩

আধুনিক কৃষির জন্য প্রযুক্তি আশির্বাদস্বরূপ। বর্তমানে, পুরোনো চাষাবাদ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তন এবং কৃষি জমির সংকোচন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা এই জটিল কাজটিকে আরও জটিলতর করে তুলছে। একসময় বাংলাদেশ নিয়মিত খাদ্য সংকটের মধ্যে ছিল। সেখান থেকে আজ আমরা খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা এবং কার্যকর খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ। এছাড়াও, উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহারের ফলে প্রতি একরে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণের বেশি বেড়েছে, যার পেছনে উন্নত জাতের বীজের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। উন্নত জাত ব্যবহারের ফলে কেবল ফলনই বাড়েনি, কমেছে রোগ ও পোকামাকড়ের প্রকোপ। বাংলাদেশ বর্তমানে ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষিখাতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অন্তর্ভুক্তি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। একসময় লাঙল-জোয়ালের উপর নির্ভরশীল কৃষি এখন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার এবং কম্বাইন হারভেস্টারের মতো যন্ত্রের সাহায্যে পরিচালিত হচ্ছে। এই যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুধু কৃষিকাজকে সহজই করেনি, বরং উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৯৫% জমি এখন পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করা হয়, যা চাষের সময় ও খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। আধুনিক সেচ পদ্ধতির মাধ্যমে সারা বছর কৃষিকাজ করা সম্ভব হয়েছে এবং বৃষ্টি নির্ভরতা কমেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৮০% সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। পানির অপচয় কমাতে এবং শস্যের গোড়ায় সঠিক পরিমাণ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রিপ ইরিগেশন বা স্প্রিংকলার পদ্ধতির মতো আধুনিক সেচ ব্যবস্থা। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করে নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রোপণ করায় ফসলের বৃদ্ধি সুষম হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কম্বাইন হারভেস্টারের মতো যন্ত্রের ব্যবহার ফসল কাটা, মাড়াই এবং ঝাড়াই প্রক্রিয়াকে একীভূত করেছে, যার ফলে ফসল তোলার সময় অপচয় প্রায় ২০-২৫% কমে এসেছে।

বাংলাদেশের কৃষিখাতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়লেও, এর একটি বড় অংশ এখনো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এটি একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ সৃষ্টি করে, তেমনি দেশের কৃষকের জন্য যন্ত্রপাতির খরচও বাড়িয়ে দেয়। এই নির্ভরতা কমাতে দেশের অভ্যন্তরেই কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন এবং উদ্ভাবন জরুরি। দেশীয়ভাবে যন্ত্রপাতি উৎপাদন করার মাধ্যমে আমদানি ব্যয় কমানো সম্ভব, যা প্রতি বছর কয়েক শত কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারে। এটি শুধু কৃষকদের জন্য যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা বাড়াবে না, বরং স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্রপাতির নকশা ও কার্যকারিতা উন্নত করাও সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মাটির ধরন এবং ফসলের বৈচিত্র্য বিবেচনা করে বিশেষভাবে তৈরি যন্ত্রপাতি বিদেশি যন্ত্রের চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে।

এই আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, কৃষি প্রকৌশল গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং স্থানীয় প্রকৌশলী ও কারিগরদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশীয় উৎপাদনকারীদের জন্য সরকারি প্রণোদনা, কর সুবিধা এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ছোট আকারের কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছে, যা এই খাতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তৃতীয়ত, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প খাতের মধ্যে নিবিড় সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে গবেষণার ফলাফল দ্রুত শিল্পে প্রয়োগ করা যায়। এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু নিজের চাহিদা মেটাবে না, বরং ভবিষ্যতে কৃষি যন্ত্রপাতি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারবে, যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। উৎপাদিত খাদ্যকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত না করলে তার একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখানে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসল কাটার পর থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ খাদ্য অপচয় হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর উৎপাদিত ফসলের প্রায় ২০-২৫% অপচয় হয়, যার আর্থিক মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্যাকেজিং এই অপচয়কে অনেকাংশে হ্রাস করতে সক্ষম। শাকসবজি ও ফলমূল থেকে জ্যাম, জেলি, জুস তৈরি, অথবা মাছ-মাংসের শুঁটকি ও প্যাকেটজাতকরণ—এই সব পদ্ধতি খাদ্যের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়।

বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান বর্তমানে প্রায় ১৩%, যার একটি বড় অংশ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্প থেকে আসে। এটি একটি বিশাল শিল্প যা গ্রামীণ এবং শহুরে উভয় ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। কৃষিপণ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং এবং বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হয়। এতে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের অনেক প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের খাদ্য ও কৃষি পণ্যের রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যার মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অবদান উল্লেখযোগ্য।

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সম্ভাবনা অপরিসীম হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। কৃষকদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তির সুফল পৌঁছানো, কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো সরবরাহ করা—এগুলো অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণের ফলে দেশের কৃষিখাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এই উত্তরণের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা হারানো, যার ফলে বিভিন্ন দেশে কৃষি রপ্তানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে রপ্তানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং রপ্তানি আয় কমতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশ কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল ও স্বল্পসুদে ঋণের সুবিধা হারাবে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য খামার তৈরি করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও উচ্চমূল্যের পণ্যের দিকে নজর দেওয়া জরুরি হবে। উত্তরণ পরবর্তী সময়ে কৃষিখাতে ভর্তুকি নীতিকে আরও স্বচ্ছ ও সীমিত করতে হবে কারণ তখন আর LDC স্তরের সহায়তা পাওয়া যাবে না। এই অবস্থায় প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে কৃষি রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং মূল্য সংযোজিত পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি, নীতি প্রয়োগে কিছুটা নমনীয়তা ধরে রাখতে "বাংলাদেশ নেট ফুড ইম্পোর্টিং ডেভেলপিং কান্ট্রি" সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।

আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই

দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে কুয়াকাটা

বাংলাদেশের দক্ষিণে উপকূলীয় এলাকার বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করছে সাগরকন্যা খ্যাত পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। গরিবের

মিয়ানমারে পরাশক্তির উপস্থিতি ও আধিপত্য-বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং স্বার্থ সুরক্ষা

মিয়ানমার দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংযোগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। একুশ শতকের উন্নয়ন ও অগ্রগতির

ক্ষমতার পালাবদল হলেও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি অপরিবর্তিত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার পালাবদল বহুবার হয়েছে। এক সরকার গিয়েছে, আরেক সরকার এসেছে। ক্ষমতার এই

রোহিঙ্গা নেতৃত্ব বিকাশ ও অধিকার আদায়ের সংগ্রাম

রোহিঙ্গা সংকটের শুরু মিয়ানমারে এবং মিয়ানমারেই রয়েছে এই সংকটের সমাধান। প্রায় আট বছর ধরে বাংলাদেশে
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইসির প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণ এনসিপিসহ অন্তত ১৬ দল

ময়মনসিংহ জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত

২৫ বছরেও এমপিওভুক্ত হয়নি দিঘীসগুনা এম.এ.আর নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়

আগামী নির্বাচনে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়ন হবে: এডভোকেট সাইফুর রহমান

বিমানবন্দরে যাত্রীর সঙ্গে প্রবেশে সীমা, গাড়ি থামবে সর্বোচ্চ দুই মিনিট

উল্লাপাড়ায় করতোয়া নদীতে গোসলে নেমে নিখোঁজ স্কুলছাত্র

গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে প্রেসক্লাব আলফাডাঙ্গার মানববন্ধন

সীতাকুণ্ডে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু

যমজ সন্তান জন্ম দেওয়ায় স্ত্রীকে নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিলো স্বামীর পরিবার

গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের মানববন্ধন

মেয়েদের আরেক ইতিহাস, প্রথমবার অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়ান কাপে বাংলাদেশ

আগামী নির্বাচনে অধিকাংশ ভোট পাবে বিএনপি: তারেক রহমান

ভারতের কোটি ডলারের গার্মেন্টস অর্ডার যাচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানে

সংসদের উভয়কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে ভোট না হলে আন্দোলনে নামবে জামায়াত

লি‌বিয়া থে‌কে দে‌শে ফিরছেন আরও ১৬০ বাংলা‌দে‌শি

আইবিএতে বাংলাদেশ বুথান মার্শাল আর্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সভা

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার গুঞ্জনের মধ্যেই আটক চীনের শীর্ষ কূটনীতিক লিউ জিয়ানচাও

মঙ্গলবার বাজারে আসছে ১০০ টাকার নতুন নোট

জাতীয় যুবশক্তির উদ্যোগে প্রথমবারের মতো জাতীয় যুব সম্মেলন মঙ্গলবার

হাসিনা-ইউনূস দ্বন্দ্বে আমি ‘বলির পাঠা’: টিউলিপ