* সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মদদে বিস্তার ঘটে বারের
* তারকা হোটেল আমারিতে মাসুদ রানার তত্বাবধানে শীশা বারের সাথে চলে রাতভর ডিজে পার্টি
* নিয়মিত উৎকোচ নিয়ে বারগুলোতে সুবিধা দিয়ে আসছে মাদকের ইন্সপেক্টর সুমন
* হোটল বয়ের চাকরি করা মোক্তার হোসেন এখন ৫টি বারের মালিক
রাজধানীতে অবৈধ সীসা বারে সয়লাব। ছোট ছোট ফ্লাট ভাড়া নিয়ে অবৈধ্য শীশা বারের ব্যাবসা করে আসছে একাধিক চক্র। শুধু তাই নয় অনেক রেস্টুরেন্টেও এখন শীশা পাওয়া যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। আশ্চার্যের বিষয় হলো এসব অবৈধ শীশা এবং বারের বিস্তার ঘটেছে খোদ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ছত্রছায়ায়। এমনকি তার ছেলে ও স্ত্রী জড়িত মদের বারের সাথে। যত্র-তত্র গড়ে উঠা এসব অবৈধ সীসা বার দীর্ঘদিন ধরে উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছে মাদক বিরোধী সংগঠনগুলো। খোদ রাজধানীতেই বৈধ বারের সংখ্যা ৯৭ টি। আর অবৈধ বারের সংখ্যা ১ টি ।
গুলশানে কোয়ালিটি ইন বারটি পুরোটাই অবৈধ। এই বারে নিয়মিত যাতায়াত করতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে শাফি মোদাচ্ছেদ খান। পুরো বারটার দায়িত্বেই ছিলেন তিনি। যার কারণে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে প্রশাসন কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান। কূটনৈতিক পাড়ার এই এলাকার আশপাশের বেশির ভাগই আবাসিক ভবন। এখানেই চার তারকা হোটেল আমারি। ভোর ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে অবৈধ শীশা বার। সেখানে রাতভর চলে নানা বয়সী তরুণ-তরুণীর আড্ডা। স্থানীয়দের অভিযোগ রাত যতই গভীর হয় বাড়তে থাকে সেখানে ভিড়। বাড়তে থাকে হৈ হুল্লুড়। এই আমারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক অশোক কেজরিউয়াল গুলশান-২ এর ৪১ নাম্বার সড়কের ৪৭ নাম্বার বাসায় থাকেন। তিনি মূলত সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিম এর নেতৃত্বে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগিতায় এই বার পরিচালনা করতেন। জানা গেছে, এখানে অনেক আওয়ামী পন্থির গোপন বৈঠকও সম্পন্ন হতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমারি বারে অবৈধ কমকান্ড চলে আসছে। তাছাড়া শীশা বারের ভেতর কোনো ধরনের বিছানা থাকার কথা না। কিন্তু সেখানে একটি ডিজে রুম পাওয়া গেছে থাই গ্লাস দেয়া সোফার আদলে একটি বেডও রয়েছে। অনুসন্ধান বলছে ওই রুমে মদ খাওয়ার পাশাপাশি অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকান্ডও চলে। এমনকি সীসার সাথে তারা মাদক ব্যবহার করে এমন অভিযোগও আছে ।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এ সকল অপকর্মের মূলহোতা মো মাসুদ রানা। ঠিকানা গ্রাম- নীলটেক, ডাকঘর- জয়মনটপ-১৮২২, শিংগাইর, মানিকগঞ্জ। মাসুদ বিভিন্ন ভিআইপি ক্লাইন্টদের আধুনিক পাড়ার যৌনকর্মী যোগান দিতো, এতে করে ওই নারীদের সাথে তার ব্যক্তিগত সক্ষতা গড়ে উঠে। অঢ়েল সম্পদের মালিক মাসুদ রানা। মানিকগঞ্জে করেছে তিনতলা ডুপ্লেক্স বাড়িও। গুলশান ২ এ কিং ফিশারের নিচে গিরোছ নামে এক রেস্টুরেন্ট আছে মাসুদের সেখানকার পার্টনার মাসুদ ও গুলশান থানার এসআই আনোয়ার খান।
এমনকি অনেক মেয়েদের নিয়ে দেশ এবং বিদেশে ঘুরতে গিয়েছেন নিয়মিত। তাদের মধ্যে সুমনা নামের এক নারীর সাথে তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিভটুগেদার করে আসছেন বলে জানা যায়।
অভিযোগ আছে, মাসুদ বিভিন্নভাবে অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিদেরকে তার যোগান দেয়া নারীদেরকে দিয়ে ফাঁদে ফেলে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেন। তিনি এখানে নিয়মিত ডিজে পরিচালনা করছেন।
এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক অশোক কেজরিওয়ালের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি অভিযোগ অস্বিকার করে বলেন, এমন হলে মাসুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এদিকে মাদকের ইন্সপেক্টর সুমনকে অতিরিক্ত উৎকোচ দিয়ে ভোর রাত পর্যন্ত ব্যবসা পরিচালনা করছে আমারি নামের এই হোটেলটি।
এসব বিষয়ে ইন্সপেক্টর সুমনের একটি অডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে। অডিও ক্লিপ থেকে জানা যায়, গুলশানে বিভিন্ন ফাইভ স্টার হোটেল বা বারে ডিজে আয়োজন করার জন্য রাত প্রতি ইন্সপেক্টর সুমনকে লক্ষ টাকা দেওয়ার রীতি চালু আছে।
এদিকে অভিযোগের সূত্র ধরে শুরু হওয়া অনুসন্ধানে মেলে হৈ হুল্লড়ের নেপথ্যে থাকা আরেক নামকরা প্রতিষ্ঠান কিংফিশার রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার। যেখানে মদের ব্যবসার আড়ালে অবাধে চলছে অপ্রাপ্ত বয়সী মেয়েদের আনাগোনা। উচ্চ শব্দের মিউজিকের তালে তালে আলো-আধারির এই রেস্তোরায় রাত খানিকটা বেশিই রঙিন হয় রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, রাত হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে আন্ডার এইজড কিশোর কিশোরী আর তরুণ-তরুণী এই এলাকায় ভিড় করে। পাশাপাশি মাতাল অবস্থায় সারা রাত এলাকা মাথায় তুলে রাখে তারা।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ওই বারের মালিক মোক্তার হোসেন নামের এক ব্যক্তি। বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার জহিরাবাদ এলাকায়। তারই একসময়কার সহকর্মীরা জানান, রাজধানীতে মোক্তারের পদধূলি অন্তত তিন দশকেরও বেশি সময় আগে। মদ বিয়ার তথা বার ব্যবসা শুরুর আগে মহাখালীর আবাসিক হোটেলের চাকুরি ছেড়ে অভিজাত পাড়া গুলশান বনানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে রুম সার্ভিস সেবা দিতেন মোক্তার। তবে মোক্তারের ভাগ্য পাল্টে যেতে শুরু করে রুম সার্ভিসের পাশাপাশি গ্রাহকদের অনৈতিক যতসব বাড়তি সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়ে। ২০০৮ সালে মোক্তার বারিধারায় বেবিলিয়ন নামে একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে লেকভিউ হোটেলের বার ওয়েটার হন।
এখন শতকোটি টাকার মালিক মোক্তার। ঢাকার গুলশান-১ লেকভিউ, গুলশান-২ এ কোরিয়ান ক্লাব (কেবি) ও উত্তরা, মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জে ৫টি বার রয়েছে খোদ মোক্তারের নামে। কিছু কিছু বার আবার পরিবারের সদস্যদের নামেও খুলে বসেছেন মোক্তার। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, শুধু দেশেই নয় যুক্তরাষ্ট্র ,কানাডা দুবাইসহ বেশ কযেকটি দেশে পাচারের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় জমাচ্ছেন মোক্তার। তার স্ত্রী সন্তান বর্তমানে সেখানেই বসবাস করছেন।
অভিযোগ উঠেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মদদে থানা পুলিশ আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই বার মালিক। জানা যায়, এই বার মালিকের সাথে শেয়ারে ছিলেন সাবেক ওই মন্ত্রীর সহধর্মিনী। তিনি পর্দার আড়ালে থেকেই সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে কয়েক দফায় মোক্তার হোসেনের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা চালানোর পর তার হোটেল কর্মচারিরা জানান, দেশে নেই তিনি। পরে মুঠোফোনে দফায় দফায় ফোন দিয়েও মেলেনি উত্তর।
এ বিষয়ে মাদকের মহাপরিচালক খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রমান পেলে মাদকের ইন্সপেক্টর সুমন ও বার গুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে ।
দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী ঢাকায় গড়ে উঠা অবৈধ সীসা বার উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছে মাদকবিরোধী সংগঠন ‘প্রত্যাশা’, বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য বিরোধী ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতারা বলেন, দেশে মাদকের ব্যবহার যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে তোলা অসম্ভব হবে।
আমার বার্তা/এমই